পিচ রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে দুধসাদা গাড়িটা থামতেই হইচই পড়ে গেল বিয়ে বাড়িতে। কিন্তু মূহুর্তের মধ্যেই ভুল ভাঙল বর কোথায়? গাড়ি থেকে নামলেন মহকুমাশাসক। বিয়েবাড়ির আনন্দ বদলে গেল আতঙ্কে। আর পড়শিদের চাপা ফিসফাস,‘‘বাড়িশুদ্ধ সবাইকে এ বার বোধহয় গ্রেফতার করবে রে!”’ না, সে পথ যাননি তেহট্টের মহকুমাশাসক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য। সটান বাড়িতে ঢুকে পাত্রী বছর বারোর কিশোরী রেখা খাতুনের চোখের জল মুছিয়ে মহকুমাশাসক প্রশ্ন করলেন, ‘‘আজ কার জন্মদিন তুমি জান?’’ মাথা নেড়ে রেখা তার অজ্ঞতার কথা জানায় এরপরেই বিয়ে বাড়ির উৎসব প্রাঙ্গণে বাল্যবিবাহ রোধে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সম্পর্কে দু-চার কথা শুনিয়েও দেন সুদীপ্তবাবু। তারপর স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এখনই এ মেয়ের বিয়ে সম্ভব নয়।
রেখার বইপত্র নিয়ে এসে উঠোনে বসেই শিক্ষকের মত তিনি তাকে বোঝাতে থাকেন ইংরেজি ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল।
তারপর মেয়েটিকে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন, ‘‘কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবে।’’ সেইসঙ্গে উঠোনভর্তি লোকজনকে তিনি জানান নাবালিকার বিয়ে দিলে কি কি ক্ষতি হতে পারে শেষপর্যন্ত অবশ্য বাড়ির লোকজনকে বুঝিয়ে রুখে দেওয়া গিয়েছে নাবালিকার বিয়ে প্রথমদিকে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও পরে রেখাও জানায়, ‘‘আমি আবার স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করব।’’ |
হোগলবেড়িয়ার পোড়াঘাটি গ্রামে বুধবার সকাল থেকেই চলছিল বিয়ের আয়োজন বাড়ির উঠোনেই চলছিল রান্না। দুপুরেই বিয়ে করতে আসার কথা ছিল পাশের পাড়ার পাত্রের। কিন্তু তার আগেই খবর পেয়ে বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন মহকুমাশাসক। রেখা খাতুন স্থানীয় হোগলবেড়িয়া আদর্শ শিক্ষানিকেতনের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা আবু বক্কর মালিথ্যা পেশায় দিন মজুর। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে বক্করের অভাবের সংসার। তিনি বলেন, ‘‘কি করব বলুন? সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পাত্রের বাড়ি আমাদের গ্রামেই ভাল ছেলে তাই হাতছাড়া করতে চাইনি।”
এরপর পাত্রের বাড়িতে যান সুদীপ্তবাবু। সেখানে পাত্র কামরুল মালিথ্যা অবশ্য জানায়, ‘‘আমি জানতাম না যে পাত্রী নাবালিকা।’’ সুদীপ্তবাবু বলেন, ‘‘রেখার বাড়িতে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া যাবে না।” বর্ণপরিচয়ের স্রষ্টার জন্মদিনে নাবালিকার এই বিয়ে রুখে দেওয়ার পর সুদীপ্তবাবু বলছেন, “বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য আর কিই বা হতে পারে!”
প্রশাসনিক তৎপরতায় নদিয়ার ধানতলায় কুশবেড়িয়াতেও বন্ধ হল নাবালিকা বিয়ে। বুধবার সন্ধ্যায় গ্রামের চোদ্দ বছরের সুচিত্রা মল্লিকের বিয়ে ঠিক হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার রামচন্দ্রপুরের নিশ্চিন্ত সরকারের সঙ্গে। সকাল থেকেই বিয়ে বাড়িতে ছিল উৎসবের মেজাজ। কিন্তু তা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নাবালিকার বিয়ের খবর পৌঁছে যায় মানবধিকার সংগঠন ও প্রশাসনের কাছে। এরপরেই ছন্দপতন ঘটে। রানাঘাট ২ বিডিও সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘স্থানীয় একটি মানবধিকার সংগঠনের কর্মীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওই নাবালিকার বাবাকে ধানতলা থানাতে ডাকা হয়েছিল। সেখানেই তাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।’’ নাবালিকার বাবা নিমাই মল্লিক পেশায় ভ্যানচালক। দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে তার টানাটানির সংসার। ছোট মেয়ে সুচিত্রা তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে লেখাপড়ায় ইতি টানে। |