প্রবন্ধ ১...
চূড়ান্ত সফল: উন্নয়নে নয়, রাজনীতিতে
কেমন চালালেন মুখ্যমন্ত্রী প্রথম পাঁচশো দিন? যে সব ভাইয়ের কপালে ফোঁটা এবং সেই সুবাদে যমদুয়ারে কাঁটা পড়েছে, তাঁরা কী বলবেন জানি না বা হয়তো জানি, আর জানি বলেই আপাতত এড়িয়ে যেতে চাইছি কিন্তু তাঁরা বাদে আর পাঁচ জন বলবেন, এই প্রথম পাঁচশো দিন পশ্চিমবঙ্গকে আরও অতলে নামিয়েছে। সেই অতলে আরাবুল ইসলাম আছেন, শঙ্কুদেব পণ্ডা আছেন, রাজারহাটের সিন্ডিকেট আছে, অম্বিকেশ মহাপাত্র আর শিলাদিত্য চৌধুরীর হয়রানি আছে, ধর্ষণের বাড়বাড়ন্ত আছে, চিরঞ্জিৎ আছেন, ‘সাজানো ঘটনা’ আছে কিন্তু শিল্পের জন্য জমি নেই, মুখ্যমন্ত্রীর জেদের খামতি নেই। সেই অতলে খুচরো বিপণনে বিদেশি পুঁজির বিরোধিতা আছে কিন্তু কৃষকের জন্য, কৃষির জন্য কোনও পরিকল্পনা নেই; বাসভাড়া না বাড়ানোর ধনুর্ভঙ্গ পণ আছে কিন্তু রাস্তায় বাস চলল কি না, দেখার দায় নেই। এত কিছু বলার পরে ‘এই সরকার উদ্ভ্রান্ত, নীতিহীন’ বলা ছাড়া আর উপায় কী থাকে?
যাঁরা সে কথা বলবেন, তাঁরা রাজনীতির পাটিগণিতে নেহাত কাঁচা। নচেৎ বুঝতেন, কোনও রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় এসে ‘বিশ্বজনের ভাল হোক’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। প্রথম লক্ষ্য হল যাঁরা ভোট দিয়ে দলকে ক্ষমতায় এনেছেন, তাঁদের দেখা। দ্বিতীয় লক্ষ্য, পরের বার যাতে আরও বেশি লোক ভোট দেন, তার ব্যবস্থা করা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য-ব্যর্থতা বুঝতে গেলেও এই মাঠেই বুঝতে হবে। আর সে ভাবে দেখলে বুঝবেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সফল প্রথম পাঁচশো দিন খুব কম মুখ্যমন্ত্রীই কাটিয়েছেন।
যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থক, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই সিপিএম-এর রাজনীতির সন্তান। আমরা-ওরা’ই তাঁদের রাষ্ট্রভাষা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ভাষা থেকে সরে আসেননি। শপথগ্রহণের পর তিনি বিরোধীদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মহাকরণে সর্বদল বৈঠকের পর বিরোধী দলনেতাকে নিজের ঘরে ডেকে এনে একান্তে কথা বলেছিলেন, এগিয়ে দিয়েছিলেন ভিআইপি লিফ্ট পর্যন্ত। কিন্তু সেই ছবি টেকেনি। সবার ওপরে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সত্য, ফলে চায়ের দোকানে সিপিএম সমর্থককে দেখলে সেই দোকানে না বসার ফতোয়াই এই বঙ্গে বাস্তব হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী সব অনর্থেই সিপিএম-এর ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। শিশুমৃত্যু হলেও বলেছেন, এই শিশুগুলি যখন মাতৃগর্ভে এসেছিল, তখন সিপিএম আমল ছিল। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ছেড়ে মাঝপথে বেরিয়ে এসেছেন, প্রশ্নকর্তাকে সিপিএম বলে দেগে দিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, আমরা ‘কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিভির চ্যানেল বদলে ফেলব, বড় জোর ফেসবুকের দেওয়ালে প্রতিবাদকৃত্য সারব। আমাদের দীর্ঘশ্বাস থেকে ঝড় উঠবে না, তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা-ওরা’র রাজনীতি অবশ্য সিপিএম-ও করেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাতে সিপিএম-কে দশ গোল দিয়েছেন, তা হল আমরা-র চেহারা নির্মাণ। তাঁর আমরা-য় কারা আছে, আর কারা থাকতে পারে, সে হিসেব তাঁর কাছে অতি স্পষ্ট। কী করে তাঁদের রাখতে হবে, সেই হিসেবও। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমাজেও যে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে, এবং সিপিএম যে তার উনিশ শতকের নীতিমালার বোঝা নামিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করতে পারবে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন। জানেন, কী ভাবে শ্রেণি-ধর্ম-জাত, আত্মপরিচয়ের সমস্ত উপাদান অক্ষুণ্ণ রেখে রাজনীতি নির্মাণ করতে হয়, যাতে তাঁর ভোটব্যাঙ্ক তাঁর সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে কখনও ইতস্তত না করে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান সাফল্য এখানেই।
কৃষি থাক, শিল্প গেলে যাক তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনের মূল ঘাঁটি দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চল। এই সমর্থকদের একটা বড় অংশ কৃষিজীবী, বড় জোর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। যেটুকু জমি আছে, সেই জমিতে এঁদের শিকড় গাঁথা। যতখানি না কৃষির প্রতি ভালবাসায়, তার চেয়ে ঢের বেশি বিকল্পের অনিশ্চয়তার ভয়ে। শিল্প এসে তাঁদের জমি নিয়ে নিলে আখেরে যে তাঁদের লবডঙ্কা, এই কথাটি তাঁদের মনে অক্ষয়। আশঙ্কার কতটা ঠিক কতটা ভুল, পণ্ডিতরা সে তর্ক করুন মুখ্যমন্ত্রী জানেন, এই আশঙ্কাই বাস্তব। সিপিএম প্রাণে মরে প্রমাণ করে গিয়েছে, কৃষকের জমিতে হাত দেওয়া এই বাংলায় রাজনৈতিক আত্মহত্যার সহজতম উপায়। অতএব তৃণমূল সেই রাস্তায় হাঁটেনি। বেসরকারি উদ্যোগের জন্য কোনও অবস্থাতেই সরকার জমি নেবে না, এমনকী হাসপাতাল তৈরির জন্যও নয়, এই কথাটি আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী এমন জোর গলায় বলেননি।
তাঁর এই রাজনীতিতে যে শিল্প আসবে না, মুখ্যমন্ত্রীও নির্ঘাত জানেন। মুখে যা-ই বলুন, শিল্প নিয়ে সম্ভবত তাঁর মাথাব্যথা নেই। তিনি জানেন, তাঁর ভোটব্যাঙ্ক শিল্প চায় না। একটা ইনফোসিস এল না গেল, শিল্পপতিরা তাঁর ল্যান্ডব্যাঙ্কের রূপকথায় বিশ্বাস করলেন কি না, এতে শহুরে মধ্যবিত্তের শিরঃপীড়া হতে পারে, মা-মাটি-মানুষের বয়ে গিয়েছে। ফলে বেঙ্গল লিডস সম্মেলনেই হোক, বা কোনও বণিকসভায় বিনিয়োগকারীদের মুখোমুখি হয়ে, জমি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এড়িয়ে যেতে অসুবিধা হয়নি তাঁর।
যাঁরা ভিন্ন প্রত্যাশা নিয়ে পরিবর্তনের পক্ষপাতী হয়েছিলেন, তাঁরা এখনও তৃণমূল কংগ্রেসের ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ পড়ে দেখতে পারেন। দেখবেন, শিল্পকে বাঁ হাতে ফুল ছুঁইয়েই প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছে নথিখানা। মা-মাটি-মানুষ যা নিয়ে ভাবিত নয়, সে কথা দলও ভাববে না। দল জানে, এই বাংলায় এখনও কৃষকের বিকল্প নেই। ফলে অমিত মিত্রর বাজেটে সিপিএম-এর আমলের বহুপ্রচারিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ফিরে আসে দু’একটা শব্দের এদিক-ওদিকসমেত ‘কৃষক আমাদের গৌরব, কৃষি আমাদের সম্পদ’। খেয়াল করবেন, সিপিএম-এর আমদানি করা ‘শিল্প’ শব্দটা স্লোগান থেকে বেমালুম ভ্যানিশ (এই রে, ‘ভ্যানিশ’ বলে ফেললাম)।
শিল্প গেছে, এসেছে অনেক কিছু। রাজ্য সরকার সাত লক্ষেরও বেশি কৃষককে কিষান ক্রেডিট কার্ড দিয়েছে। গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্কগুলো এক বার অনাদায়ী কৃষি ঋণ উদ্ধার করতে কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিশ ঝুলিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী বকে দেওয়ায় কেউ আর ও সব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। তাবড় তাবড় বড়লোকরাও যখন ব্যাঙ্কের টাকা বেমালুম মেরে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে দিব্যি আছেন, তখন কৃষকের গলায় গামছা দিয়ে বকেয়া টাকা আদায় না করতে পারলেই দাস ক্যাপিটাল অশুদ্ধ হবে, এমন কথা মুখ্যমন্ত্রীর ঘোর সমালোচকও বলবেন না। তবে, মুখ্যমন্ত্রীর মন কোথায়, সেটা খেয়াল রাখা ভাল।
খুচরো বিপণনে বিদেশি পুঁজি এলে কৃষকের লাভ না ক্ষতি, আমি জানি না। জানেন বলে যাঁরা দু’পক্ষের কোনও এক দিকে গলা ফাটাচ্ছেন, সম্ভবত তাঁরাও জানেন না। যেটুকু সবাই জানেন, তা হল, এই নতুন ব্যবস্থা মানে আরও এক দফা অনিশ্চয়তা। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনিশ্চয়তাকে ভয় পায়। কাজেই মুখ্যমন্ত্রী ঝাঁপিয়ে পড়ে সংস্কারের বিরোধিতা করলেন। তাতে আর একটা লাভ হল। অভব্য ভাষায় যাঁদের ফড়ে বলে, তাঁদের স্বার্থ দিব্যি বজায় থাকল অথচ তাঁদের নিয়ে একটা কথাও খরচ করতে হল না। রাজনৈতিক মুনশিয়ানা তো বটেই। এই সুযোগে মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কটিও ঘুচিয়ে ফেললেন। ২০১৪ সালে, সম্ভবত রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে, কংগ্রেস ফের লোকসভায় জিতবে, এমন কথা বললে ২৪ আকবর রোডের চেয়ার-টেবিলও এখন হাসছে। সেই ডুবন্ত নৌকা থেকে সময়মত নেমে তৃতীয় ফ্রন্টের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টারস্ট্রোক।
আমি তোমাদেরই লোক তৃতীয় ফ্রন্টই। এন ডি এ নয়। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় বিজেপি-র দোসর হয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আজকের মুখ্যমন্ত্রীর আসমান-জমিন ফারাক। মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের কাছে গ্রহণযোগ্যতায় তাঁর তুলনা এখন এক জনই ভবিষ্যতের তৃতীয় ফ্রন্টে তাঁর সম্ভাব্য সহযোগী ‘মৌলানা’ মুলায়ম সিংহ যাদব। ‘সংখ্যালঘু রাজনীতি’ কথাটা নিতান্তই গৌরবে সমষ্টিবাচক বিশেষ্যর ব্যবহার গোটা দেশেই সংখ্যালঘু মানে মুসলমান। এক সময় পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোটে অধিকার ছিল বামপন্থীদের। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুসলমান জনগণমনের একচ্ছত্র অধিনায়িকা। গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখলে সংশয় থাকবে না। রাজ্যে মোট ৩৭টি আসনে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২৭টিতে জয়ী হয়েছে। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের ৭টি আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি আসনে জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থীরা। তৃণমূলের প্রধান দুর্গ দক্ষিণবঙ্গে, যেখানে ১৩টি জেলায় পুরুলিয়া আর বাঁকুড়া বাদে প্রতিটিতেই গড়পড়তা ২৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান, সেখানে ৩০জন সংখ্যালঘু তৃণমূল প্রার্থীর মধ্যে জয়ী ২৫ জন। ভারতীয় রাজনীতির পরিচিত ছক যে কেন্দ্রে মুসলমানরাই সংখ্যাগুরু, সেখানে মুসলমান প্রার্থী দিতে হয়। এই আসনগুলোও সম্ভবত সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। আর নয় বলেই, সংখ্যালঘুর মন কোন দিকে, এই ফলাফল থেকে সেটা বোঝা যায়।
সংখ্যালঘুর মন রাখার চেষ্টা বামফ্রন্টও করেছিল। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের কথাও বলেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কাজেই, মমতা যখন মুসলমানদের আরও কিছু জাতকে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত করলেন, তার মধ্যে এমন কিছু নতুনত্ব ছিল না। কাজেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, রাজ্যে শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের জন্য হাসপাতাল তৈরি হবে। ঘোষিত হল, অতঃপর উর্দু সরকারি কাজের ভাষার স্বীকৃতি পাবে। পশ্চিমবঙ্গের কত শতাংশ মুসলমান উর্দু পড়তে পারেন? সামান্যই। কিন্তু উর্দু যে ‘মুসলমানদের ভাষা’, সেটা উর্দু না পড়তে পারা মুসলমানরাও মানেন।
এতে সাধারণ মুসলমানের উন্নয়ন হবে না, মুখ্যমন্ত্রী জানেন। যেমন জানেন, উন্নয়নে রাজনীতি হয় না। ৩০,০০০ ইমামের জন্য মাসে ২৫০০ টাকা ভাতা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের নাকি বাড়িও বানিয়ে দেওয়া হবে। ইমামরা টাকা পেলে সাধারণ মুসলমানের কী? মুখ্যমন্ত্রী জানেন, নির্বাচনের সময় এলে কোন বোতাম টিপলে মুসলমান ভাইদের উন্নতি হবে, সেটা বলে দিতে ইমামরা ভুলবেন না। সেই নির্দেশে ভোট পড়ে কি না, তা আলাদা তর্ক, কিন্তু মসজিদ হয়ে ব্যালট বাক্সের এই পথটি গোটা দেশের চেনা।
যদি এইটুকুই হত, তাও অনেক। মমতা এখানেই থামেননি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি আত্মপরিচয়ের রাজনীতির পথে হাঁটলেন। একটু অন্য ভাবে। তিনি নতুন করে নিজের পরিচয় নির্মাণ করলেন। রাজ্যের সর্বত্র তাঁর চাদরে মাথা ঢাকা ছবিতে শোভিত হোর্ডিং ঝুলছে। নমাজের ভঙ্গিতে হাত তোলা ছবি? তা-ও আছে। শহুরে মধ্যবিত্ত হাসবে, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা খেপে লাল হবেন। কিন্তু মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ দেখতে পাবে, এই প্রথম রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষে এমন এক জন বসেছেন, যিনি তাঁদের সংস্কৃতি বোঝেন। রাজাবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে বসে সামনের সিটের দুই বোরখাপরিহিত নারীর কথা শুনেছিলাম এক বার দেখেছিস, কেমন জানে? জানালা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঈদের শুভেচ্ছা দেখা যাচ্ছিল। এই দেখতে পাওয়ার রাজনৈতিক দাম এখনও হিসেবের অতীত।
এই আত্মপরিচয় নির্মাণও মমতার জন্য নতুন নয়। ২০১০ সালে তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের সদস্য হয়েছিলেন। রাজ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ সওয়া কোটির কাছাকাছি। দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলাতেই তাঁদের মূল বাস, এবং দক্ষিণবঙ্গের ৭৪টি বিধানসভা আসনের ফল তাঁদের ভোটে নির্ধারিত হতে পারে। ‘বড়মা’কে প্রণাম করছেন তিনি, এই ছবিটা খুব কম প্রচার পায়নি। এই ২১ তারিখ মতুয়াদের ধর্মগুরুর নামাঙ্কিত কলেজের শিলান্যাসে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ‘বড়মা’-কে প্রণাম করে বললেন, ‘(বড়মা চেয়েছিলেন বলে) অনেক বড় বড় কাজ শেষ না করেই এখানে এসেছি। বড়মার জন্য এটুকু আমি করতেই পারি।’ যে কারণে তাঁকে চাদরে মাথা ঢাকতে হয়, ঠিক সেই কারণেই মতুয়া হয়ে বড়মার আশীর্বাদ নিতে হয় যাঁরা তাঁর সমর্থক, এবং সম্ভাব্য সমর্থক, তিনি যে তাঁদেরই লোক, এই কথাটা স্পষ্ট করে দিতে মমতা কখনও ভুল করেননি।
কেন মমতার এই আত্মপরিচয় নির্মাণের গল্পটি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব? পশ্চিমবঙ্গের জন্মাবধি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বর্ণহিন্দুরা ব্রাহ্মণ, বৈদ্য আর কুলীন কায়স্থ, অথবা এক ব্রাহ্ম। এই রাজ্যে এখনও পর্যন্ত কোনও মুলায়ম সিংহ যাদব বা লালুপ্রসাদ যাদব, কোনও মায়াবতী বা নীতীশ কুমার তৈরি হননি। রাজ্যের দু’কোটিরও বেশি মুসলমানের মধ্যে থেকে উঠে আসেননি কোনও সর্বজনমান্য নেতা। অচিরে তৈরি হবেন তেমন কেউ, সেই সম্ভাবনা কম। ফলে, নিম্নবর্গের হিন্দু বা মুসলমানদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির যে খিদেই তৈরি হোক, তা পূরণ করার মতো নেতা ছিলেন না। মমতা জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ। কিন্তু তাঁর পরিচয়ে কোথাও উচ্চবর্গের ছাপ নেই। তিনি উচ্চবর্গকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, উচ্চবর্গ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সেই প্রত্যাখ্যানের গল্প মুসলমানরা জানেন, নিম্নবর্গীয়রাও জানেন। ফলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিজেকে ‘তোমাদের লোক’ হিসেবে দেখাতে চান, তাঁরা সন্দেহ করেন না। তাঁকে আপন বলে স্বীকার করে নেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ধর্মও বোঝেন, কৃষকের বিপন্নতাও বোঝেন। তাঁরা জানেন, তাঁদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতি যদি কারও হাত ধরে এগোতে পারে, তবে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর পর উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা অর্থহীন। তাঁর রাজনীতি যে পথে চলছে, সে পথে উন্নয়নের স্টপেজ নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.