ভর্তুকির সিলিন্ডার নিয়ে দর কষাকষি করে সরকার ছাড়লেন মুখ্যমন্ত্রী।
কোন মেয়েদের জন্য তাঁর এই লড়াই? কী তাঁর রাজনীতি? প্রশ্ন তুলেছেন
স্বাতী ভট্টাচার্য |
মনের ভাব যা প্রকাশ করে তা-ই ভাষা। আবার ভাষাও নতুন করে ভাবায়। যেমন এই শব্দটা, ‘নীতি।’ ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ‘মর্যালিটি’ কিংবা ‘এথিক’, সেই ন্যায় বিধানকে ‘নীতি’ বলা হয়। আবার সরকার কোনও লক্ষ্যে পৌঁছতে যে উপায় বা ‘পলিসি’ তৈরি করে, সেই কার্যবিধিকেও বাংলায় আমরা বলি ‘নীতি’। এত আলাদা দুটো অর্থের জন্য একটাই শব্দ কেন বরাদ্দ বাংলায়?
নাকি, এটাই ঠিক? সরকারি নীতি শেষ অবধি যা ঠিক করে তা হল, কে পাবে, কোন শর্তে পাবে। প্রতিটি পাওয়ার মধ্যে ঢুকে থাকে অনেকের না-পাওয়া। কেজো নীতির মধ্যে জুড়ে বসেছে ন্যায়নীতির বিচার। আলাদা করতে গেলে অন্যায় হবেই, তাই কি দুটোর জন্য একটা শব্দ?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, বছরে ২৪টা রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারে ভর্তুকি দিতে হবে। মনমোহন সিংহ দিতে চাইছেন ছ’টায়। সিলিন্ডার-পিছু ভর্তুকি যদি ৪০০ টাকা ধরা যায়, তা হলে পরিবার-পিছু মনমোহন বছরে ২,৪০০ টাকা খরচ করতে চাইছেন। মমতা দাবি করছেন, দিতে হবে আরও ৭,২০০ টাকা। এ রাজ্যে ৪৮ লক্ষ গ্যাস গ্রাহক রয়েছেন, তাই বাড়তি ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৪৫৬ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী রাজি হননি, মমতা সরকার ছেড়েছেন। কিন্তু তাতেই তো দাবির ন্যায্যতার প্রশ্নটা শেষ হয়ে যায় না। কথাটার নিষ্পত্তি দরকার।
তাই ভাবতে হচ্ছে, কার জন্য ভর্তুকি চাই? কত চাই? সেটা আন্দাজ করতে গেলে দেখতে হবে এ রাজ্যের হেঁশেলের ছবি। কে কী জ্বালানি দিয়ে রান্না করে, তার নকশা পাওয়া যায় গৃহস্থালি জনগণনায়। সদ্য ছেপে বেরিয়েছে ২০১১ সালের রিপোট। দেখা যাচ্ছে এ রাজ্যে গ্যাসের ব্যবহার অতি সামান্য (১৮ শতাংশ), পাঁচজনে একজনও নয়। ভারতের চেয়ে এ বিষয়ে পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে তিন জনে প্রায় এক জন গ্যাস ব্যবহার করে (২৯ শতাংশ)। কিন্তু আমাদের রাজ্যে গ্যাস ব্যবহার করছে কারা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চলে তিন ভাবে। |
শ্রমের মূল্যে জ্বালানি। এই মেয়েদের রান্নাঘরে ঢোকে না কোনও সরকারি অনুদান। |
এক, যাদের মধ্যে দারিদ্র সব চাইতে বেশি, সেই তফশিলি জাতির পরিবারে গ্যাস ব্যবহার আট শতাংশ, জনজাতি পরিবারে ছয় শতাংশ। এঁদের বাদ দিলে বাকি জনসংখ্যায় গ্যাসের প্রচলন ২২ শতাংশ।
দুই, গ্রামে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হয় না বললেই চলে। ২০১০ সালে জনগণনার হিসেবে যে ৩৬ লক্ষ গৃহস্থালিতে গ্যাস আছে এ রাজ্যে, তার ৩০ লক্ষেরও বেশি রয়েছে শহরে। দলিত-আদিবাসীদের মধ্যেও ৭৮ শতাংশ গ্যাসের হেঁশেল শহুরে পরিবারে।
আর তিন, গ্যাসের হেঁশেলের সিংহভাগই রয়েছে কলকাতা আর তার আশেপাশে। দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি আর কলকাতা, এই পাঁচটি জেলা মিলিয়ে রয়েছে ২৩ লক্ষ গ্রাহক। কলকাতায় যত দলিত-আদিবাসী পরিবার রয়েছে, তাঁদের অর্ধেকেরই রান্নাঘরে গ্যাস রয়েছে। কিন্তু দলিত-আদিবাসী প্রধান জেলাগুলোতে (পুরুলিয়া, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার) তাঁদের গ্যাসের ব্যবহার অতি সামান্য।
এ থেকে কী কী স্পষ্ট হয়? বাড়তি ভর্তুকির টাকা যাবে তাঁদের কাছেই বেশি, যাঁরা উচ্চবর্ণ। দলিত-আদিবাসী, যাঁদের মধ্যে দারিদ্র তীব্র, তাঁদের অতি সামান্য অংশের কাজে লাগবে। দুই, গ্রামবাসীরা প্রায় সকলেই বাদ পড়বেন, শহুরে পরিবার এর সুযোগ পাবেন। আর তিন, টাকার সিংহভাগ ঢুকবে কলকাতার মানুষদের পকেটে। মালদহ, কোচবিহার, দুই দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দুই মেদিনীপুর, এই দশটি জেলার মানুষ মিলিয়েও তত ‘ক্যাশ ব্যাক’ পাবেন না সরকারের থেকে, যত পাবেন কেবল কলকাতার লোকেরা।
এই বৈষম্য আরও তীব্র মনে হয় যখন দেখি যে রান্না করার জন্য কেরোসিনের ব্যবহার হয় যে চার লক্ষ মতো পরিবারে, তার অর্ধেক কলকাতায়। শুধু তাই নয়, কলকাতায় দেওয়া হয় মাথাপিছু দুই লিটার কেরোসিন, জেলায় ৯০০ মিলিলিটার। এ বার ধরুন তেল কোম্পানি ডিলারকে কম মাপে তেল দেওয়া, আর ডিলার গ্রাহককে কম মাপে তেল দিয়ে ঠকানোর হিসেবটা। জাতীয় একটি সমীক্ষা বলছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০ শতাংশ রেশনের কেরোসিন বিক্রি হয় বাজারে। তা হলে হিসেব করুন রান্নার জ্বালানিতে যে বিশাল ভর্তুকি সরকার দেয়, বাস্তবে তার কতটুকু গিয়ে পৌঁছয় গরিব মা-বউদের হেঁশেলে। গ্রামে যেটুকু কেরোসিন তারা হাতে পায়, তা আলো জ্বালাতেই ব্যবহার হয়ে যায়। এ রাজ্যের গ্রামে ৬০ শতাংশ বাড়িতেই ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে কেরোসিনের আলোয়। এখানেও ভূগোলের মাহাত্ম্য স্পষ্ট কলকাতার কোল-ঘেঁষা হাওড়া আর হুগলির গ্রামে আলোর জন্য কেরোসিন জ্বলে কম, বিদ্যুৎ চলে বেশি। দার্জিলিং বাদে বাকিদের আলো জ্বালতে প্রধান ভরসা কেরোসিন।
বাঙালির হেঁশেলের ছবিটা অতি বিবর্ণ, অতি বিমর্ষ। এ রাজ্যের অধিকাংশ গৃহস্থালিতে মেয়েরা রান্না করে কাঠকুটো, খড়কুটো দিয়ে। বাংলার ২০ লক্ষেরও বেশি পরিবারে মেয়েরা এখনও ঘুঁটে দিয়ে উনুন জ্বালায়। আন্দাজ করা কঠিন নয়, এদের বেশির ভাগই নিজের হাতে গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে দেয়। এরাই নিয়ে আসে জোগাড় করে ডালপালা, খড়, ঘাস, পাট কাঠি, শুকনো পাতা। কয়লা ভাঙে, গুল দেয়। যেমন করতেন এদের মা-দিদিমা, তাদেরও মা-দিদিমারা। অনেকে বলেন, এ হল ‘ফ্রি ফুয়েল’ পাওয়ার ঝোঁক। কুড়িয়ে পেলে আর পয়সা দিয়ে কেনা কেন? সেই ‘বিশেষজ্ঞরা’ ধরে নিচ্ছেন, গ্রামের মেয়েদের শ্রমটা মিনিমাগনা। বহু সময়, পরিশ্রমে মেয়েরা তৈরি করে, জোগাড় করে এমন জ্বালানি যার শক্তি অতি সামান্য, যার ধোঁয়া এবং গুঁড়ো ক্ষতি করে শরীরের, পরিবেশের। গরিব মেয়েদের কাছে কী করে উন্নত, পরিষ্কার, কার্যকরী জ্বালানি পৌঁছে দেওয়া যাবে, সে প্রশ্নটাও আজ অবধি কেউ করে উঠতে পারল না। ভারতে ‘এনার্জি পলিসি’ নিয়ে যা কথা হয়, তার প্রায় গোটাটাই জুড়ে থাকে তেল আমদানি, তেলের খনি বণ্টন, আর পেট্রোল-ডিজেলে ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ে চাপান-উতোর। দেশের অধিকাংশ মেয়ের রান্নাঘরে কাছে কী করে পৌঁছে দেওয়া যাবে আধুনিক জ্বালানি, কেমন করে একবিংশের জীবনযাত্রায় যোগ করা যায় গ্রামের মেয়েদের, সেই ন্যায়নীতির কথাটা সরকারি শক্তিনীতি থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জ্বালানির প্রশ্ন নিয়ে ঝড় তুললেন দেশে, যখন গোটা দেশ তাকিয়ে ছিল পশ্চিমবঙ্গের সিদ্ধান্তের দিকে, তখন গোটা ভারতের কাঠ-কুড়ুনি, ঘুঁটে-কুড়ুনি মেয়েদের জন্য এক অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তাদের তর্জনী উঠতে পারতে এই অভিযোগে, ‘যে সুযোগ তোমরা এত দিন অবাধে ভোগ করেছো, তা আমাদের দেওয়ার আগে তোমরা কেড়ে নিচ্ছ। আগে আমাদের সহজ শর্তে, কম দামে গ্যাস দেবার প্রতিশ্রুতি দাও। তার পর বিচার করো, কার জন্য ভর্তুকি কমাবে, কত কমাবে।’
এ কথার সামনে নতজানু হতে হত যে কোনও সরকারকে। রাজনীতি যখন দাঁড়ায় ন্যায়ের পক্ষে, তখন তার শক্তি অপরিমিত। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিচক্ষণ, তিনি জানেন, মানুষের তর্জনী এক বার উঠতে দিলে সে যে কার দিকে নির্দেশ করবে, তার ঠিক নেই। হয়তো মহাকরণের দিকেই আঙুল দেখিয়ে ওই মেয়েরা বলে উঠবে, ‘যাদের গ্যাস নেই, অন্ধ্র প্রদেশের শহরে তারা মাসে ১০-২৩ লিটার কেরোসিন পায়, হরিয়ানায় মাসে ১০ লিটার, হিমাচলে ২০ লিটার, কেরলে ছয় লিটার। পশ্চিমবঙ্গে শহরে দুই লিটার কেন? অন্য রাজ্যে গ্রামবাসী কেউ তিন লিটারের কম কেরোসিন পায় না, দারিদ্রের স্তর অনুসারে ১০ লিটার, ২০ লিটারও পাওয়া যায়। আমাদের এক লিটারও জোটে না কেন?’ তারা চেঁচাতে পারে, ‘আমাদের কেরোসিন কেন বাজারে বিকোয়, ডিজেলে মেশে? কেন রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার যায় গাড়ি চালাতে, ব্যবসা চালাতে? কেন ভর্তুকির ডিজেল দিয়ে গাড়িতে এয়ারকন্ডিশন চলে? ভর্তুকির কত টাকা যায় বাবুদের ঘরে, না জেনেই আরও চাইছ কেন?’
মমতা যদি ‘গরিবের জন্য প্রতিবাদ’ থেকে কখনও আসেন ‘গরিবের জন্য প্রশাসন’ অবধি, তা হলে হয়তো খেয়াল করবেন যে ময়দানে দাঁড়িয়ে ‘সবাই সমান’ বলা চলে, প্রশাসনে বসে সবাইকে সমান দিতে গেলে তা গরিবের প্রতি চরম অন্যায় হয়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি রাজ্যের জন্য কেরোসিনে ভর্তুকি কমিয়েছে গ্যাস সংযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। যারা গ্যাসে ভর্তুকি পাচ্ছে, তারা বাদ পড়বে কেরোসিনে ভর্তুকির সুবিধে থেকে, এই হল কেন্দ্রের নীতি। সেই অনুসারে উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর দ্বীপ রাজ্যগুলি ছাড়া প্রায় সব রাজ্য ডাবল সিলিন্ডার গ্রাহকদের কেরোসিন বরাদ্দ বন্ধ করেছে, সিঙ্গল সিলিন্ডারে কমিয়ে দিয়েছে। সেই জন্যই গরিবদের প্রাপ্য কেরোসিন সে সব রাজ্যে বেশি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎহীন, গ্যাসহীন পরিবারকে যত কেরোসিন দেয়, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযুক্ত পরিবারকেও তাই দেয়। অর্থাৎ বড়লোককে ভর্তুকি দিচ্ছে গরিব। এই সরকারি নীতির মধ্যে ন্যায়ের নীতি কোথায়?
ইন্ডিয়ান অয়েল সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গে এখন ৪৮ লক্ষ গ্যাস গ্রাহক, সিলিন্ডার লাগে মাসে গড়ে ৪৯ লক্ষ। মানে গড় চাহিদা মাসে ১.০২ সিলিন্ডার। তার দ্বিগুণ সংখ্যাক সিলিন্ডারে মমতা ভর্তুকি চাইলেন, যার অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। রাজ্যের অন্তত ৭৫ শতাংশ মেয়ে-বউ, যাদের হেঁশেলে না আছে গ্যাস, না কেরোসিন, ওই টাকার উপর দাবি তাদেরই কি বেশি ছিল না? তারা কি শূন্য হাতেই ফিরে যাবে চিরকাল?
কোন মায়েদের ভোটে ক্ষমতায় এসেছিল মা-মাটি-মানুষের সরকার, আর আজ মহাকরণে দাঁড়িয়ে সওয়াল করছে কোন মায়েদের জন্য। |