বাঙালি মাত্রেই ভাববাদী ও ভক্তিবাদী। নানা প্রকার ভাবজনিত ও ভক্তিজনিত প্রকাশেই বাঙালির আগ্রহ। কুলোকে বলিবে, বাঙালি কর্মবাদ বুঝে না, চাহে না, বাঙালি কর্ম করিতে পারে না, (সুতরাং) সে ভাব ও ভক্তির চর্চা করে। যে চর্চায় কায়িক শ্রম লাগে না, বসিয়া বসিয়াই যাহা করিয়া ফেলা যায়, সেই কাজই বাংলার মানুষের পক্ষে শ্রেয় ও প্রেয়। কুলোকের মন্দ কথায় কান না দিয়া বরং বলা যাক যে যাহা পারে, তাহাই তাহার ধর্ম। যে যাহা পারে না, তাহা পরিত্যাজ্য। বাঙালি যাহা পারে তাহা মনে রাখিয়া বলা যাক, ভাব ও ভক্তির প্রকাশটি বাঙালির আসে ভাল, তাহাতেই তাহার মনঃসংযোগ করা উচিত। তাই যদি কিছুকে বা কাহাকে বাঙালির সম্মান দর্শাইতে হয়, সে ক্ষেত্রেও ভজনার পথই তাহার পক্ষে প্রশস্ত, সর্বোত্তম। খাটিয়াখুটিয়া কাজ করিয়া আত্মধর্মের বিপরীতে গিয়া সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে হৃদয়ের অনাবিল প্রকাশ কোথায়! সেই কারণেই, ভক্তিপ্রকাশের লক্ষ্যে বাঙালির জন্য ভজনাই শ্রেষ্ঠ পথ। আর সেই ভজনার জন্য চাই বাঙালির ছুটি! সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যায়তনগুলিতে ছুটি ঘোষণা করিল। ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিবস।
বিদ্যাসাগরের জন্মদিবসটি এই প্রথম রাজ্যে ছাত্রছাত্রীরা ছুটি হিসাবে পালন করিল। ইহার অর্থ পরিষ্কার: এই প্রথম রাজ্যের আবালবৃদ্ধবনিতা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সম্যক ভাবে শ্রদ্ধা জানাইল। এত দিন যাবৎ, সেই ঊনবিংশ শতক ইস্তক, তাঁহাকে যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো হয় নাই বলিয়াই এই ব্যবস্থা। বর্তমান রাজ্য সরকারের দূরদর্শিতা ও সংস্কৃতিবোধ ভূয়সী প্রশংসা দাবি করে। তাঁহারা চোখে আঙুল দিয়া না দেখাইলে বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাঙালির নিকট আজও অধরাই থাকিয়া যাইত। পরপার হইতে নিশ্চয়ই তিনি আশিস বর্ষণ করিতেছেন। নিজে যদিও বাঙালির এই জাতীয় ভক্তিভাব-সংস্কৃতির বহু দূরে বিরাজ করিতেন, নিজে যদিও বাঙালি জাতীয় স্বভাবের জ্বলন্ত ব্যতিক্রম হিসাবে প্রায় একক হস্তে কর্মযোগ ও শিক্ষাযোগকে আরাধ্য ও আরাধনায় পরিণত করিয়াছিলেন, তবু সন্দেহ কী দয়ার সাগর পুরুষটি বাঙালির এই আনন্দমুখরিত ভক্তিরঞ্জিত ভাববিগলিত ছুটির উদ্যাপন দেখিয়া স্মিতকরুণ-হাস্যে রাজ্যবাসীকে স্নেহাশীর্বাদই বিতরণ করিতেন। দুর্বলকে যে কোনও প্রকারে রক্ষা করিতে তাঁহার যে জুড়ি ছিল না!
অর্থাৎ, বাঙালির নূতন সরকারের এই ‘ছুটি-বাদে’ বিদ্যাসাগরের সমস্যাও নাই, অসম্মানও নাই, তিনি এ সবের ঊর্ধ্বে, তিনি ভাববাদী ভক্তিবাদী বাঙালি বেচারির স্বভাব-সমাচার আদ্যোপান্ত জানেন। সমস্যা রাজ্য সরকারের পথ নির্বাচনে। কী ভাবে এই ‘ছুটি-বাদ’-এর সঙ্গে বাঙালির বর্তমান সরকার তাঁহাদের বহু-বিজ্ঞাপিত কর্ম-সংস্কৃতির নীতিটিকে মিলাইতেছেন, সেই প্রশ্নের সমস্যা। এক হাতে ‘কাজ চালু’ ঝাণ্ডা ও অন্য হাতে ‘পড়া বন্ধ’ ঝাণ্ডা লইয়া কেমন ভাবে বাঙালি মা-মাটি-মানুষ অগ্রসর হইবে, এই প্রশ্ন সম্ভবত বিদ্যাসাগরকেও অত্যন্ত সংকটাপন্ন করিয়া তুলিবে, কেননা তিনি আবার প্রবল যুক্তিবাদী। যুক্তি ছাড়া কিছুই তাঁহার গ্রহণীয় নহে। আর এক মহা-যুক্তিবাদী বিবেকানন্দও তাঁহার সহিত গলা মিলাইতে পারেন, এই বৎসর তাঁহার জন্মদিবসটিও ছুটিবাদের আওতায় আসিয়াছে কি না। কথা হইল ইঁহারা যখন যুগ্ম-কণ্ঠনিনাদে প্রশ্ন তুলিবেন: বন্ধ যদি ‘না’ হয়, ছুটি তবে ‘হ্যাঁ’ কেন সেই তীক্ষ্ণ যুক্তিবাণের সামনে আত্মরক্ষা করিবার উপযুক্ত বর্ম ও বিপরীত-যুক্তির অস্ত্র বাঙালির মুখ্যমন্ত্রী মজুত রাখিয়াছেন তো? |