বামপন্থীরা লুপ্তপ্রায় হইয়াছেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের স্কন্ধারূঢ় বামপন্থার ভূত যেমন ছিল, তেমনই আছে। আপাতত হলদিয়া বন্দরে তাহারই উপদ্রব চলিতেছে। আশাবাদীরা বলিবেন, ইহা ব্যতিক্রম। পূর্বে যেমন এক মাইল পথ হাঁটিলে তিনটি কারখানার বন্ধ দরজার সম্মুখে লালশালু চোখে পড়িত, এখন তো তেমন দেখা যায় না। সত্য, কিন্তু তাহা ভূতের ব্যর্থতা নহে এই পোড়া বঙ্গে বন্ধ করিবার মতো কারখানা আর বাঁচিয়া নাই। হলদিয়া আছে, সেখানে ভূতের উপদ্রবও আছে। শালুটি আর লাল নাই, ইহাই পার্থক্য। স্পষ্ট বলা প্রয়োজন, যে বেসরকারি সংস্থাটিকে কেন্দ্র করিয়া বর্তমান অশান্তি, সেই এবিজিও সমস্যার দায়ভাগ এড়াইতে পারে না। যে ভাবে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠাইয়া সংস্থাটি ২৭৫ জন কর্মীকে ছাঁটাই করিল, তাহাতে সংস্থাটির কাজের ধরন সম্বন্ধে একটি আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। নমনীয় শ্রম আইন আর তুঘলকি আচরণের ফারাক অলঙ্ঘ্যনীয়। কিন্তু, সংস্থাটির দোষের পর্দায় শ্রমিক সংগঠনের অন্যায়ের মুখটি ঢাকা যাইবে না। বহিরাগত রাজনৈতিক নেতা ‘আন্দোলন’ পরিচালনা করিতেছেন, আন্দোলনের সহিত শৃঙ্খলার দিবা-রাত্রির সম্পর্ক সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। এই পশ্চিমবঙ্গই যে ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’তে ঘেরাও শব্দটিকে ঠাঁই করিয়া দিয়াছিল, তাহা বিলক্ষণ বোঝা যায়।
হলদিয়ায় যাহা চলিতেছে, তাহা একান্তই পশ্চিমবঙ্গীয়। এবিজি সংস্থাটির পরিকাঠামো হলদিয়ার অন্যান্য ডকগুলির তুলনায় আধুনিকতর। তাহাদের শ্রমিকের প্রয়োজনও কম। কিন্তু সংস্থাটি যখন হলদিয়ায় আসে, তখন তাহাদের প্রয়োজনের অনেক বেশি কর্মীকে বহাল করিতে বাধ্য করা হয়। যতগুলি জাহাজ তাহাদের ডকে ভিড়িলে পরিকাঠামো এবং কর্মী সংখ্যার সহিত কাজের বহরের সাযুজ্য থাকে, তত জাহাজ এই সংস্থার ডক দুইটিতে আসিত না। সব মিলাইয়া সংস্থাটির নাকি লোকসানই হইতেছিল। এই দাবির কতখানি ঠিক, তাহা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু গায়ের জোরে শর্ত চাপাইয়া দিয়া যে শিল্পের বিকাশ ঘটে না, এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে কেহ বুঝিতে নারাজ। বস্তুত, ২০১০ সালে এই সংস্থাটি যখন হলদিয়ায় আসিয়াছিল, তখন লক্ষ্মণ শেঠের পড়ন্ত বেলা হলদিয়া বন্দরে ঘাসফুল ফুটিয়াছে। মা-মাটি-মানুষের দোহাই দিয়া শিল্পের শ্বাসরোধ করিতে বর্তমান শাসকদের ঠেকে না, মানুষ এই কথাটি অভিজ্ঞতায় বুঝিয়াছেন। হলদিয়াই বা ব্যতিক্রম হইবে কেন?
বস্তুত, যিনি হলদিয়ায় সর্বার্থেই লক্ষ্মণ শেঠের উত্তরসূরি, সেই শুভেন্দু অধিকারী হলদিয়ায় ‘আন্দোলনরত শ্রমিকদের’ বলিয়াছেন, সরকার তাঁহাদের পার্শ্বেই আছে। তাঁহারা যেন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে দ্বিধা না করেন। এই কথা বলিয়া লাভ নাই যে শুভেন্দু হলদিয়া বন্দরে চাকুরি করেন না, ফলে বন্দরের শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলনে উপস্থিত থাকিবার বৈধতা তাঁহার নাই। এই সরল যুক্তিটি বুঝিবার সামর্থ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমাজের নাই। ‘শুভেন্দু’-দের উপস্থিতি, অতএব, অনিবার্য। তিনি জনপ্রতিনিধি। পশ্চিমবঙ্গ নামক দুর্ভাগ্য রাজ্যটির স্বার্থরক্ষাই তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি সর্বদা যাহার পার্শ্বে থাকিবেন, তাহার নাম পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যটি রক্তাল্পতায় ভুগিতেছে। যুক্তফ্রন্টের আমলে ‘ঘেরাও মন্ত্রী’ সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে শিল্পের স্বার্থহানির যে ধারা এই রাজ্যে আরম্ভ হইয়াছিল, বামপন্থী এবং বামপন্থীতর শাসকদের হাতে সেই ধারা ক্রমেই পুষ্ট হইয়াছে, শিল্পের শ্বাসরোধ করিয়াছে। রাজনীতির দাপটে পশ্চিমবঙ্গে আর শিল্প নাই শুভেন্দু অধিকারীরা এই ভাবে শ্রমিকদের ‘পার্শ্বে থাকিলে’ এইটুকুও থাকিবে না। তাহাতে রাজনীতির কী লাভ, রাজনীতিকরা জানেন। তবে একটি জরুরি কথা তাঁহাদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক শিল্প না থাকিলে শ্রমিকও নাই। ভবিষ্যতে তাঁহারা কাহার পার্শ্বে থাকিবেন? |