উন্নতির মুখ জয়পুর
দিন বদলেছে ‘মেট্রো’, আরও ‘কোম্পানি’ আসুক
সোজা কথাটা সোজা করে বোঝেন ওঁরা। ওঁরা মানে জয়পুর গ্রামের ২৪টি চাষি পরিবার।
উত্তর ২৪ পরগনার পূর্ব খিলকাপুরের গ্রাম জয়পুর। ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’কে সব্জি বেচে জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে ২৪টি পরিবারের। খুচরোয় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে এত হইচইয়ের মধ্যে জয়পুরের বাসিন্দারা কিন্তু সারসত্য বুঝে গিয়েছেন। এবং ওঁরা সবাই বলছেন, আরও বেশি ‘কোম্পানি’ গ্রামে এসে মাল কিনে নিয়ে গেলে ভাল। আরও অনেকগুলি পরিবার আর্থিক ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তবে।
কী ভাবে?
‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’ আসার পরে ফড়েদের আর তোয়াক্কা করেন না চাষিরা। তাঁদের এলাকায় ফড়েদের প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ। আর তাতেই পাল্টে গিয়েছে জীবন। ফড়েরাজের দাপটে চাষের খরচ তুলতেই হিমসিম খাচ্ছেন রাজ্যের কৃষকরা, অনেকে হাটেই ফেলে আসছেন ফসল। তখন জয়পুরের ওই ২৪ জনের এক জন শুধু সব্জি বিক্রির লাভের টাকা দিয়েই কিনে ফেলেছেন আরও এক বিঘে জমি। বাকিরা কেউ কাঁচা বাড়িটা পাকা করেছেন। কেউ কিনেছেন মোবাইল ফোন। ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন স্কুলে। জীবনবিমাও করেছেন অনেকে।
আর এ সবই ঘটেছে বছর দেড়েকের মধ্যে। কলকাতা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের জয়পুরে গিয়ে সরাসরি সব্জি কেনা শুরু করেছে ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’। আর তখনই আশপাশের গ্রামগুলির চেয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া শুরু জয়পুরের। মাঠ থেকে ফসল কেটে নিজেই বয়ে এনে সংস্থার অফিসে তুলে দিচ্ছেন চাষিরা। হাতে-হাতে গুনে নিচ্ছেন সব্জির দাম। নতুন তৈরি হওয়া আনসার আলির চায়ের দোকানে চা খেয়ে জিরিয়ে নিচ্ছেন কেউ। মুরগির মাংসের দোকানেও বেশ ভিড়।
দিনবদলের ছাপ কৃষক মহিউদ্দিন মণ্ডলের (ডান দিকে) পোশাকেও। ছবি: সুদীপ ঘোষ
অন্য গ্রামের চেয়ে এই গ্রামে বিক্রি বেশি, তাই ভ্যান রিকশায় হরেক কিসিমের মালপত্র নিয়ে ফেরি করছেন বামনগাছি থেকে আসা রফিকুল ইসলাম। নতুন তৈরি হওয়া মোবাইলের দোকান থেকে ‘রিচার্জ’ করছেন অনেকে। দোকানের মালিক মসিহুল রহমানের কথায়, “কেনা-বেচা বেড়েছে। মোবাইল ফোন সারানোর কাজও করছি।” কেউ আবার মনিহারি দোকান থেকে ‘বিবি’-র জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ‘ফর্সা হওয়ার ক্রিম’। মেট্রোকে সব্জি বিক্রি করতে আগ্রহী আরও অনেক চাষিই। কিন্তু ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’র মুখপাত্র জানালেন, ‘‘আপাতত গ্রামের সবার থেকে ফসল কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই অনেককেই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।”
ইতিমধ্যেই চাউর হয়ে গিয়েছে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের কথা। সে সব শুনে রীতিমতো হতাশ চাষিরা। সব্জি উৎপাদক আজগার আলি বলেন, “গত মরসুমেও ৮ কাঠা জমিতে মুলো চাষ করে বিক্রি করতে পারিনি। মাঠে পচেছে মুলো। কিছু মাল হাটেই ফেলে এসেছি। ভ্যানভাড়াও ওঠেনি।”
জয়পুরের আশপাশের গ্রামগুলিতে আজও চাষিদের জীবনে রয়েছে এই চেনা দুর্গতি। মুরালি গ্রামের মইদুল ইসলাম, নূর মহম্মদ মণ্ডল, আতর আলি-র মতো চাষিদের সব্জি পচছে মাঠেই। মইদুল বলেন, “পাট, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন সবেতেই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। হাটে মাল ফেলে দিয়ে এসেছি।” জুম্মান আলি নামে এক চাষি বললেন, “ফড়েদের কাছে পাঁচ টাকা কেজি দামে ঢ্যাঁড়স বিক্রি করছি। সেখানে মেট্রো নিজে গ্রামে এসে তা সাত টাকায় কিনছে। কোনও কোম্পানি গ্রামে এসে মাল কিনলে যে আখেরে চাষিরই লাভ হয়, তা সব চাষিই বোঝেন।”
যেমন বুঝেছেন জয়পুরের মহিউদ্দিন মণ্ডল। বুধবার খেত থেকে ঢ্যাঁড়স তুলে নিজেই বিক্রি করছিলেন ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’তে। গত তিন মাসে ১৫ কাঠা জমিতে টমেটো আর লাউ চাষ করে ২৪ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। মহিউদ্দিন বলেন, “হাটে এই মাল বিক্রি করলে এর অর্ধেক লাভও পেতাম না।” কেন? জয়পুরের বৃদ্ধ কৃষক আজান আলির ব্যাখ্যা, সপ্তাহে দু’দিন করে হাট বসে। হাটের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। ভ্যান রিকশায় মাল নিয়ে যেতেই অনেক খরচ হয়ে যায়। তার পরে হাটে সেই মাল রাখতে খরচ হয়। সবার উপরে রয়েছে ফড়েদের খবরদারি। মহিউদ্দিন, আজানদের বক্তব্য, “এখন হাট চলে এসেছে গ্রামে। যে কোনও দিন মাথায় করে মেট্রোতে মাল দিয়ে এলেই হল। লাভ হবে না?”
লাভের টাকা হাতে আসায় জীবনযাত্রাতেও পরিবর্তন এসেছে। লুঙ্গি ছেড়ে শার্ট-প্যান্ট পরা ধরেছেন মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, “দু’বছর আগে মাঠের ফসল হাটে ফেলে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরেছিলাম। আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে।” কিন্তু এ বার ঈদে মহিউদ্দিনের ঘরে খুশির ঢল। নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়েছেন ছেলে-বউকে। পরের ঈদে বারাসতের ‘শপিং মলে’ পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করার ইচ্ছে মহিউদ্দিনের। তিনি বলেন, “চলতি মরসুমে মাত্র দেড় বিঘে জমিতে সব্জি ফলিয়ে লাভ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। আরও এক বিঘে নতুন জমিও কিনে ফেলেছি।”
শুধু ফসল উৎপাদকেরাই নন, আসরাফ আলির মতো গ্রামের ছেলেরা ফসলের ওজন করা, বাছাইয়ের কাজ পেয়েছেন ‘মেট্রো ক্যাশ এন্ড ক্যারিতে’।
আসরাফ বলেন, “আগে গ্রামে কাজ ছিল না। কাজ পেতে বাইরে যেতে হত। সেই প্রবণতা একটু হলেও কমেছে।”
গ্রামের আর্থিক অবস্থার কী রকম পরিবর্তন হয়েছে, তা বোঝা যায় বদরহাটির বাসিন্দা জীবনবিমার ‘এজেন্ট’ কার্তিক শাসমলের কথাতেও। নতুন ‘পলিসি’ করার দূরের কথা, তাঁকে দেখলেই আগে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার আব্দার করতেন গ্রামের কৃষকেরা। আর এখন? কার্তিকবাবু বলেন, “এখন অনেকে সঞ্চয় করছেন। নতুন পলিসি বিক্রি বাড়ছে। আমার ব্যবসাও ভাল হচ্ছে।”
শুধু ফড়ে হটিয়ে গ্রামে বসে মাল বিক্রিই নয়, পরিবর্তন এসেছে চাষের পদ্ধতিতেও। জয়পুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পিয়াল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওঁরা বীজ ও সার নিয়ে সেমিনার করছেন, মাঠে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এতে বেশি ফলন মিলছে।” জয়পুরের বদলে যাওয়া এই ‘সচেতনতা’ টের পেয়েছেন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা সবিতা বিশ্বাসও। তিনি বলেন, “এখন স্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠানোর প্রবণতাও বেড়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে হাজিরাও বাড়ছে।”
লাভের ফসল তুলছে এলাকার পঞ্চায়েতও। পূর্ব খিলকাপুর পঞ্চায়েত সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, “মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি পঞ্চায়েত থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। এখানে ব্যবসা করছে বলে পঞ্চায়েতে খাজনাও দিচ্ছে। পঞ্চায়েতেরও লাভ হচ্ছে।” জয়পুরের চাষি আবদুল সিরাজ যা বললেন, সেটাই ওখানকার বেশির ভাগ মানুষেরই মনের কথা “ওঁরা আরও সব্জি কিনলে ভাল হত। আমরা চাই, ওঁরা এখান থেকে আরও সব্জি কিনুন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.