বঙ্গের রাজনীতিতেও এ বার চর্চা ‘তৃতীয়’ বিকল্পের!
চিরাচরিত লাল ও সবুজে বিভক্ত বাংলায় ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে গেরুয়া! কলেবরে বাড়ছে বিজেপি। তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি ‘মোহভঙ্গ’ এবং সিপিএমের প্রতি ‘আস্থা’ না-ফেরা এই দুইয়ের জেরে রাজ্য রাজনীতিতে তৈরি হওয়া শূন্যতাই তাদের জন্য পরিসর এনে দিচ্ছে বলে বিজেপি সূত্রের ব্যাখ্যা।
আগামী অক্টোবর মাসে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশেই বিজেপি-র সাংগঠনিক নির্বাচন আসন্ন। সেই উপলক্ষে সদস্যপদের যে হাল-হকিকত বিজেপি নেতৃত্বের হাতে এসেছে, তাতেই এই উত্থানের ছবি ধরা পড়ছে। বিজেপি-র সাংগঠনিক নির্বাচন হয় তিন বছর অন্তর। সেই সময়েই সদস্যসংখ্যার হিসাব-নিকাশ হয়। বিজেপি সূত্রের খবর, তিন বছর আগে গোটা রাজ্যে যেখানে দলের প্রাথমিক সদস্যসংখ্যা ছিল ৯০ হাজার, এ বার তার সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে ১ লক্ষ ৭৮ হাজার। সক্রিয় সদস্যের সংখ্যাও বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তিন বছর আগের ৭ হাজার থেকে এখন ১৫ হাজারের ঊর্ধ্বে। এই বৃদ্ধির হিসাব তিন বছরের হলেও রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনে’র ভোটের পরেই তাঁদের দিকে লোক আসছে বেশি। খুব সামান্য হলেও বাড়ছে ভোটের হারও। সাম্প্রতিক পুর-নির্বাচনে দুর্গাপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে ওয়ার্ড জেতা বা বাঁকুড়া বিধানসভার উপনির্বাচনে ভোটের হার বৃদ্ধি ‘তৃতীয় বিকল্প’ হিসাবে তাদের উঠে আসার দিকেই ইঙ্গিত করছে বলে বিজেপি সূত্রের দাবি।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মাওবাদী মোকাবিলায় ‘সাফল্য’ দেখিয়ে যে জঙ্গলমহলে প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শান্তি’ ফিরিয়েছেন বলে তৃণমূল প্রচার করছে, সেখানেও বেড়েছে বিজেপি! পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায় তাদের প্রাথমিক সদস্য বেড়েছে ১৬ হাজারের বেশি। বিশেষত, পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়বেতা-১ ও ২, বিনপুর, গোপীবল্লভপুর, পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের মতো জায়গায় বিজেপি-র কার্যালয় খুলেছে। সম্প্রতি গোপীবল্লভপুরে একটি হাইস্কুলের পরিচালন সমিতি নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে তারা। বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, পরিস্থিতির ফেরে এত বেশি লোক এই দল করার জন্য যোগাযোগ করছে, যে ঝাড়গ্রামকে সাংগঠনিক ভাবে আলাদা জেলা হিসাবে বিবেচনা করতে হচ্ছে! রাঢ়বঙ্গের ‘লাল বলয়ে’ যে ঘটনা এক সময়ে অভাবিত ছিল বিজেপি-র কাছে। তুলনায় অল্প হলেও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের মতো শহুরে এলাকাতেও সদস্য বাড়ছে। যে জন্য এ বার দার্জিলিং বাদে বাকি সব জেলায় সাংগঠনিক নির্বাচন করা যাবে বলে ‘আত্মবিশ্বাসী’ বিজেপি।
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, “মহিলা, কৃষক, যুব, মুসলিম যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ মমতাকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা বুঝছেন কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। আবার ৩৪ বছরে সিপিএম যা করেছে, তাদের প্রতি লোকের আর আস্থা নেই। মানুষ তাই ভাবছেন, কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সবাইকে তো এ রাজ্যে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়নি শুধু বিজেপি-কে।” রাহুলের আরও দাবি, সিপিএম ছেড়ে-আসা দুষ্কৃতীরা এখন তৃণমূলের হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তাই ‘মর্মাহত’ পুরনো তৃণমূল কর্মীদের একাংশ বিজেপি-তে নাম লেখাচ্ছেন। আবার দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ‘অভ্যাসে’র ফলে সিপিএম নেতৃত্ব নিচু তলার কর্মীদের আন্দোলনের দিশা দেখাতে পারছেন না। তাই সিপিএম থেকেও একাংশ আসছে তাঁদের দিকে। রাহুল উদাহরণ দিচ্ছেন, বিজেপি-র রাজ্য দফতরের কাছেই কলাবাগান বস্তিতে এত দিন তাঁদের একটা ঝান্ডাও লাগানো যেত না। গত বৃহস্পতিবারের বাংলা বন্ধের দিন সেই বস্তি থেকেই কয়েকশো মানুষ মিছিলে যোগ দিয়েছেন!
|
রাজ্যে সরকার থেকে বাম-বিদায়ের পরে বিজেপি ডালপালা ছড়াচ্ছে, মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম। তাঁর কথায়, “বিজেপি-র বিশ্লেষণ আংশিক সত্যি। বাম-বিরোধী মনোভাব যে বিপুল শক্তি একজোট হয়েছিল, তারা যাবে কোথায়? হতাশা থেকে তাদের একাংশ বিজেপি-তে যাচ্ছে। তা ছাড়া, তৃণমূল নেত্রীর ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিও একটা কারণ।” বস্তুত, বাম শিবিরের মতে, শুধু বিজেপি-র মতো দলের বাড়বাড়ন্তই নয়। মমতা যে পথে চলছেন, তাতে নানা ধরনের ‘মৌলবাদী’ শক্তির মাথাচাড়া দেওয়া আশ্চর্যের নয়।
তবে বাকি দেশে বিজেপি-র ‘শহরের পার্টি’ পরিচয় থাকলেও এ রাজ্যে গ্রামাঞ্চলেই তাদের বিস্তার বেশি। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বিজেপি-র ‘বিপদ’ নিয়ে ভাবিতই নন। রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “বিজেপি-র এই রিপোর্ট বাস্তবসম্মত নয়। দলের কাজে এত জেলায় জেলায় ঘুরি। কোথাও তো বিজেপি-র বাড় দেখছি না! বরং, ডিজেল, রান্নার গ্যাস এবং এফডিআই প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ মন্ত্রিসভা ও সরকার থেকে সরে আসার আত্মত্যাগ করার পরে গ্রামাঞ্চলে এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে তাঁর প্রভাব বাড়বে।” তৃণমূলের সদ্যপ্রাক্তন জোটসঙ্গী কংগ্রেসও ভাবতে নারাজ বিজেপি-কে নিয়ে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কথায়, “ওদের বিকল্প হতে চাওয়া দিবাস্বপ্ন! তবে তৃণমূলের কাজকর্মে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। তাঁদের অনেকেই এখন স্বস্তি পেয়েছেন আমরা রাজ্য সরকার ছেড়ে আসায়!”
তার মানে কি বিরোধী রাজনীতির পরিসর দখলের জন্য এ বার কংগ্রেস এবং বিজেপি, দুই সর্বভারতীয় দলের লড়াই শুরু হবে রাজ্যে? দলের কাজে ইদানীং কলকাতা যাতায়াত করতে হচ্ছে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী শাহনওয়াজ হুসেনকে। আনন্দবাজারকে তিনি অবশ্য বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির দাপট শেষ। দুর্নীতি আর জনবিরোধী সিদ্ধান্তের জন্য কংগ্রেসের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ নয়। তাই আমাদের কথা লোকে শুনছে।”
তৃণমূলের দিকে এখনও মানুষ আছে বলেই মত শাহনওয়াজের। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কেউ-ই তৃণমূলকে আক্রমণের পথে যাচ্ছেন না। উল্টে মমতা ইউপিএ ছাড়ার পরে তাঁকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে বসে আছেন! এই ঘটনা কি রাজ্য বিজেপি-র ‘বিকল্প’ হওয়ার দৌড়ে বাধা নয়? রাজ্য বিজেপি-র এক নেতা বলছেন, “যে যা-ই বলুক, মাথার হিজাব ছেড়ে উনি এখন এনডিএ-র দিকে আসবেন না! তাই আমাদের কোনও বিপদ নেই!”
বিপদ কি মমতারও আছে? বাম তো ছিলই, সঙ্গে বিরোধী পরিসরে কংগ্রেস এবং বিজেপি ভাগ বসালে ভোটের রাজনীতিতে তৃণমূল নেত্রীর হাসিই তো চওড়া হওয়ার কথা! |