দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণেই বদলে গিয়েছে জীবন
খন মাঝেমধ্যেই দুপুরবেলা মিউজিক সিস্টেমে গান শোনেন আজিজুল মোল্লা। সন্ধে হলেই টিভিতে সিরিয়াল দেখা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে মঞ্জিলা বিবির। মাটির বাড়ি পাকা করে ফেলেছেন মজিদ আলি মোল্লা।
দু’বছর আগে এ সব ভাবতেই পারতেন না কাকদ্বীপের আনন্দনগর গ্রামের আজিজুল, মঞ্জিলারা। নুন আনতে তাঁদের পান্তা ফুরত। কাজ বলতে ছিল শুধু নানা জায়গায় গিয়ে দিনমজুরি। এখন গ্রামের অনেকেই ঠিকাদারি কাজ করছেন। জমি কিনে চাষাবাদও শুরু করেছেন। কেউ নেমেছেন গাড়ি ব্যবসায়। ফলে, গ্রামে বেড়েছে কর্মসংস্থানও। দু’বছরে জীবনযাত্রার মানটাই বদলে গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই অজগাঁয়ের অনেকের।
কোনও ভোজবাজি নয়, আনন্দনগরের বাসিন্দাদের এই ‘পরিবর্তন’-এর নেপথ্যে রয়েছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। যে দুর্ঘটনায় চলে গিয়েছে গ্রামের ৩৪ জনের প্রাণ। সেই স্মৃতি এখনও টাটকা গ্রামবাসীদের মনে। এখনও নিভৃতে তাঁরা প্রিয়জন হারানোর বেদনায় চোখের জল ফেলেন। একই সঙ্গে অবশ্য এ কথাও স্বীকার করেন, সেই দুর্ঘটনার পরে জেলা পরিষদ ও রাজ্য সরকার মোট ৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ না দিলে হয়তো এই ‘পরিবর্তন’ সম্ভব হত না।
আনন্দনগর গ্রামের রমজান গাজির বাড়িতে এখন ডিশ অ্যান্টেনা। দিলীপ নস্করের তোলা ছবি।
২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর মুড়িগঙ্গা নদীতে এক ট্রলার দুর্ঘটনায় ৮৩ জন মারা যান। তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনই আনন্দনগরের। বাকি মৃতেরা ওই গ্রামেরই পুণ্যার্থীদের আত্মীয়। কেউ বারুইপুর, কেউ মন্দিরবাজার, কেউ বা কুলতলির। সরকারি হিসেবে এখনও ১৪ জন নিখোঁজ।
সেই তালিকায় আছেন আনন্দনগরের সৈয়দ মোল্লাও। যাঁর ছেলে, বছর সতেরোর তাজউদ্দিন মোল্লা দুর্ঘটনার পরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে তার বাবা-মাকে। মায়ের মৃতদেহ পেলেও বাবার খোঁজ পায়নি। বাড়িতে দুই দিদি, এক বোনকে নিয়ে তাজউদ্দিন পড়ে অথৈ জলে। জনমজুরের কাজ করে একা কী ভাবে সংসার চালাবে ভেবে কূল পায় না। ক্ষতিপূরণের টাকায় অবশ্য তাজউদ্দিনের অনেকটাই সুরাহা হয়েছে। তার কথায়, “ওই টাকায় দুই দিদির ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছি। ওটা তো বাবার দায়িত্ব ছিল। এখন বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।”
দুর্ঘটনায় মজিদ আলি মোল্লার দুই মেয়ে ও নাতি মারা যায়। ক্ষতিপূরণের টাকায় মজিদ মাটির বাড়ি পাকা করেছেন। জমি কিনে চাষাবাদও করছেন। সেখানে নিয়মিত জনমজুরির কাজ পাচ্ছেন গ্রামের কয়েক জন। মজিদ বলেন, “জামাইরা আমাকে ক্ষতিপূরণের একাংশ দিয়েছে। কিছু টাকা মসজিদে দান করেছি। বাকি টাকায় জমি কিনেছি। বাড়িটা পাকা করেছি।” আগে মজিদ দর্জির দোকানে কাজ করতেন।
দু’বছর আগে জনমজুরি করতেন রুস্তম শেখ। দুর্ঘটনায় তাঁর মা মারা যান। ক্ষতিপূরণের টাকায় নলকূপের সরঞ্জামের দোকান করেছেন রস্তম। মাটির বাড়ি পাকা হয়েছে। রুস্তমের কাছেও জনা চারেক মজুর কাজ করছেন।
বছর তিনেক আগে কলকাতায় ট্যাক্সি চালাতেন মফিজ সর্দার। ওই দুর্ঘটনায় মফিজের স্ত্রী মারা যান। ক্ষতিপূরণের টাকা ব্যাঙ্কে রেখে ধারে দু’টি গাড়ি কেনেন মফিজ। একটি নিজে চালান। অন্যটি গ্রামের আর এক জনকে চালাতে দিয়েছেন। লাভও হচ্ছে ভালই। ফের বিয়েও করেছেন।
‘পরিবর্তন’-এর এমন উদাহরণ আরও আছে।
সূর্যনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন আনন্দনগর গ্রামে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। আগে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফেরার পরে গ্রামবাসীদের আর বিশেষ কিছুই করার থাকত না। বেশির ভাগ বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। টেমির আলোয় বিনোদন বলতে ছিল রেডিও শোনা আর মাঠে-ঘাটে বসে গল্পগুজব। এখন বেশ কিছু বাড়ির ছাদে দেখা যাচ্ছে ডিশ-অ্যান্টেনা। অনেকে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছেন। রাত পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে টিভির আওয়াজ। গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রার মান যে পাল্টেছে, তা মানছেন পঞ্চায়েত প্রধান দিলীপ সর্দারও। তিনি বলেন, ‘‘ক্ষতিপূরণের টাকাটা খুব কাজে দিয়েছে। গ্রামেই অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। গরিব মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.