ফুটপাথ ফুঁড়ে খান দুই ল্যাম্প পোস্ট। সেই আলোর বৃত্তকে ঘিরে জনা পনেরো শিশু-কিশোর।
কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি... ধারাপাত... সালোকসংশ্লেষ...
তার মাঝেই “এই, সরে বোস না একটু।” অমনি জবাব, “না! দেখছিস না, ও দিকটায় আলো পড়ছে না!”
এক ধারে কিছুটা চওড়া ফুটপাথ। পান-বিড়ির দোকান, ফুচকার গাড়ি আর সুলভ শৌচাগারের গা ঘেঁষে প্লাস্টিকের ছেঁড়া মাদুরে গোল হয়ে বসেছে ওরা। যেন বাড়ির উঠোন। সেখানেই আলোর দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি। বাকি পড়ে থাকা অন্ধকারে সকলের সমান অধিকার!
খাস কলকাতার ৫৬৭ বর্গ কিলোমিটারে এক মাত্র নিষ্প্রদীপ বসত ওদেরই বাগবাজার শ্রমজীবী কলোনি। সাবেক ঠিকানা পি-২৭, ক্ষীরোদ বিদ্যাবিনোদ অ্যাভিনিউ। সাড়ে আঠারো কাঠায় ঘেঁষাঘেঁষি করে ১০২টি পরিবার। সাতষট্টি বছরের পুরনো এই কলোনির বাসিন্দারা নিয়ম করে পুরকর দেন। এ বছরেই ‘অকুপায়ার ট্যাক্স’ বাবদ তাঁদের থেকে পুরসভার আয় তিন লক্ষ টাকারও বেশি। পরিবার পিছু রেশন কার্ড আছে, ভোটার কার্ডও আছে বেশির ভাগের। এমনকী প্যান কার্ডও আছে কারও কারও। কিন্তু কোনও ঘরে টিভি নেই। যাঁদের মোবাইল আছে, চার্জ দিতে ছুটতে হয় পাশের পাড়ায়। |
সন্ধে নামলেই রেড়ির আলোয় আধো অন্ধকার ভিটে থেকে বাচ্চা-বুড়ো, কাকিমা-মাসিমারা বেরিয়ে আসেন তাঁদের ‘আলোকিত’ উঠোনে। উঁকি দিলেই ল্যাম্পপোস্টের নীচে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী! রুলটানা খাতা থেকে মুখ তোলে ষষ্ঠ শ্রেণি, “কাকু, দেখেছো আমাদের কত্ত বড় টেবিল ল্যাম্প!”
খাস কলকাতায় এমন নিরালোক তল্লাট? পুরসভার মেয়র পারিষদ (আলো ও বিদ্যুৎ) মনজুর ইকবাল সটান বলে বসেন, “অবাস্তব কথা! খাস কলকাতায় এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি।” কিন্তু বাগবাজারের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, তৃণমূলেরই মঞ্জুশ্রী চৌধুরী কিন্তু মেনে নেন, “বলতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, এত দিনেও শ্রমজীবী কলোনিতে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি।” অন্ধকারে ডুবে থাকা এই কলোনির কথা সিইএসসি-রও ‘নথিতে নেই’। সংস্থার জনসংযোগ আধিকারিক শাশ্বত ঘোষালের কথায়, “ওই কলোনির জনা কয়েক বাসিন্দা সম্প্রতি মিটারের জন্য আবেদন করেছেন। আমরা বলেছি, টাকা জমা দিলেই বিদ্যুৎ দেওয়া হবে।” ‘সম্প্রতি’ মানে ঠিক কত দিন? তিরিশ বছর ধরে আলোর জন্য আবেদন করে আসছে শ্রমজীবী কলোনি। আগের প্রজন্মের বিপ্লব মৃধা থেকে এই প্রজন্মের শম্ভু পাইক, সকলের আক্ষেপ, বহু বার সিইএসসি-র ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার (নর্থ রিজিয়ন)-এর দফতরে আবেদন করা হয়েছে। কাজ হয়নি। শম্ভুবাবুর খেদ, “প্রতি বারই সিইএসসি-র গতে বাঁধা চিঠি আসে, ইনস্পেক্টর এলাকা পরিদর্শনে আসবেন। কিন্তু তাঁর আসার
সময় হয়নি!”
বছরের পর বছর রাস্তার আলোর ভরসায় থাকা সেই কলোনিই এ বার ঘরের কোণে ছোট্ট আলোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঠিক করেছে, তারা সৌর-ল্যাম্প বসিয়ে অন্ধকার তাড়াবে। পরিকল্পনার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘জীবনের জন্য আলো’। উদ্যোগীদের অন্যতম ডি আশিস বলেন, “বিদ্যুৎ না পেয়েও ওঁরা কিন্তু হুকিংয়ের পথে যাননি। রাস্তার আলো আঁকড়েই লড়ে গিয়েছেন।” আপাতত ৫০টি বাড়িতে দু’টি করে আলো ও একটি পাখা চালানোর সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। ৪.৬০ লক্ষ টাকার এই প্রকল্পে ৩.১৫ লক্ষ টাকা বহন করছে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। সহযোগী হিসেবে রাজ্যের অপ্রচলিত শক্তি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়েবরেডা) দিচ্ছে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি। ওয়েবরেডা-র অধিকর্তা সুশোভন ভট্টাচার্যের আশ্বাস, “লম্ফ বা লণ্ঠন থেকে যে কোনও দিন আগুন লাগতে পারে। সৌর-আলোয় অন্তত দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই।” উদ্যোগীদের আর এক জন সুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তিরিশ বছর ধরে সিইএসসি-র কাছে তদ্বির করছেন ওঁরা। কিচ্ছু পাননি। এ বার সৌর-আলো ওঁদের কিছুটা স্বস্তি দেবে।”
স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ছানি পড়া চোখও। মশা তাড়াতে তাড়াতে বৃদ্ধ রামপ্রসাদ প্রামাণিক বিড়বিড় করেন, “আয়ু তো ফুরিয়ে এল। শেষ বয়সে ঘরে বসে একটু আলো দেখব, পাখার হাওয়া খাব!” সন্ধের পাঠশালা শেষ করে ছেঁড়া মলাটের ‘সভ্যতার আলো’ তত ক্ষণে ফিরে যাচ্ছে লম্ফ জ্বলা ঘরে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার অরূপ সোম ওদের দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে ওঠেন, “বাচ্চাগুলো যেন এ শতকের বিদ্যাসাগর!” |