মাঠ, বিতর্ক, প্রতিপক্ষ তিন শত্রুকেই আজ গোল দিতে চান মর্গ্যান |
রতন চক্রবর্তী • শিলিগুড়ি |
সোমবার সকাল পর্যন্ত মর্গ্যান নিশ্চিত ছিলেন কাল স্পোর্টিং ক্লুব-ওএনজিসি ম্যাচের ফল দেখে মাঠে নামতে পারবেন। কিন্তু দুপুরের পরই বদলে গেল ছবিটা! গোয়ার ক্লাবের আবেদনে সাড়া দিয়ে ফেডারেশন সিদ্ধান্ত নিল ‘গড়াপেটা’র আশঙ্কা নির্মূল করতে মঙ্গলবার একই সময়ে, বিকেল তিনটেয় দু’টি ম্যাচ করা হবে।
না, এতে চিডি-মেহতাবদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। কারণ ইস্টবেঙ্গলকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে রেখে স্পোর্টিং ক্লুবকে যে মাঠে খেলতে পাঠানো হচ্ছে সেটা যে কোনও দলের কাছেই ‘বধ্যভূমি’। পাড়া ফুটবল হওয়ার পক্ষেও অযোগ্য। গোল-সংখ্যা বাড়ানো দূরে থাক, বলই সেই মাঠে ভাল করে গড়ায় না। শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ থেকে কিছু দূরে সীমা সুরক্ষা বলয় বা, এসএসবি নামক যে মাঠে ‘গড়াপেটা আটকাতে’ জাতীয় কাপের ম্যাচ দিচ্ছে ফেডারেশন, সেখানে গত কয়েকদিন প্রায় সব দলেরই প্র্যাক্টিস করার দুঃসহ অভিজ্ঞতা আছে। অসমান মাঠ। বড় বড় ঘাস। জায়গায় জায়গায় থকথকে কাদা। মাঠে কোনও রিজার্ভ বেঞ্চ নেই। নেই ড্রেসিংরুম ও বাথরুম। সীমান্ত জওয়ানদের ছাউনি বলে মাঠে দর্শক ঢোকার অনুমতি নেই। কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ঢুকতে হয় মুচলেকা দিয়ে।
এমনিতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামকে নির্বাচিত করে ফেড কাপকে প্রায় পাড়ার টুর্নামেন্টে পরিণত করেছেন চূড়ান্ত অপেশাদার কর্তারা। চারটে সর্বভারতীয় দলের এক দিনে খেলা, অথচ ড্রেসিংরুম দু’টো। যে দুটো দলের খেলা হয়ে যাচ্ছে তারা যতক্ষণ না ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছে, পরের দু’টো দল ড্রেসিংরুম পাচ্ছে না। হা-পিত্যেশ করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে জাতীয় ফুটবলারদের পাশপাশি কোটি টাকার বিদেশিদেরও। গ্যালারির উপর মান্ধাতা আমলের বাঁশের ছাউনির প্যান্ডেল। প্রথম দিন মাঠে ঢুকে যা দেখে তাজ্জব বনে যান জাতীয় কোচ উইম কোভারম্যান্সও। ডাচ কোচ প্রশ্ন করছিলেন, “এই মাঠে কী অন্য সময় কোনও অনুষ্ঠান হয়। সে জন্যই কি ছাউনি?” এমন ভাবে ছাউনি বাঁধা হয়েছে যে, ম্যাচ কমিশনারই ভাল করে ম্যাচ দেখতে পাচ্ছেন না। দর্শকদের জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই জল খাওয়ার বা বাথরুমের। কয়েক দিন আগে ফিফার মহাসচিব জেরাম ভালকে এসেছিলেন, ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে। শিলিগুড়িতে ‘ক্লাব চ্যাম্পিয়ন অব ইন্ডিয়া’-র খেলা যে পরিকাঠামোতে হচ্ছে তা দেখলে জুরিখে ফিরে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই কালো তালিকায় ফেলে দিতেন ভারতকে। |
জঘন্য পরিকাঠামোর শিকার হয়েই একেন্দ্র সিংহের দলকে মরণবাঁচন ম্যাচ খেলতে নামতে হচ্ছে। ‘ফুটবলের ভগবান’ দুঃখীদের পাশে যদি থাকেন তা হলে আলাদা কথা। না হলে স্পোটির্ং ক্লুবের শেষ চারে যাওয়া অসম্ভব না হোক, প্রচণ্ড কঠিন। ফেডারেশন যে ভাবে সূচি তৈরি করেছে তাতেই গলদ। গ্রুপ লিগে যে কোনও সময় একাধিক দলের পয়েন্ট সমান হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। গোলপার্থক্যে চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত হয়। তা সত্ত্বেও গ্রুপের শেষ ম্যাচ প্রথমে একসঙ্গে দেওয়া হয়নি। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মাঠ তৈরি রাখার কথাও ভাবা হয়নি। বেচারা স্পোর্টিং ক্লুবঅভিযোগ করে কালু-কেইটারা এখন নিজেরাই বিপদে পড়ে গিয়েছেন। দুপুরে ম্যাচ কমিশনার জে রবিশঙ্কর সভায় বলেন, “গড়াপেটা হওয়ার আশঙ্কায় একই সময়ে দুটো ম্যাচ করার আবেদন করে চিঠি দিয়েছে স্পোর্টিং। সে জন্যই কাল একই সময়ে দু’টো ম্যাচ দেওয়া হচ্ছে।” গড়াপেটা শব্দে অবশ্য প্রচণ্ড আপত্তি তোলেন ইস্টবেঙ্গল ম্যানেজার স্বপন বল। তিনি বলেন, “দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী আমাদের ক্লাব। আমরা কখনও গড়াপেটা করি না।” ক্ষোভে তিনি সভার মিনিটস-এ সই না করে, চিঠি না নিয়ে চলে যান।
এ রকম নাটকীয় আবহে ইস্টবেঙ্গল যদি কালীঘাট মিলন সঙ্ঘকে হারিয়ে দেয় এবং স্পোর্টিং ক্লুবও যদি ওএনজিসিকে হারায় তা হলে কলকাতা এবং গোয়ার ক্লাবের সমান পয়েন্ট (৭) হবে। তখন কে শেষ চারে যাবে তা ঠিক করতে দেখা হবে গোল পার্থক্য। সেটাও সমান হলে গোল দেওয়া-খাওয়ার সংখ্যা। সব শেষে লটারি।
মর্গ্যান অবশ্য অত দূর ভাবতে চাইছেন না। দু’টো ম্যাচ একই সময় হচ্ছে শুনে তাঁর মন্তব্য, “জামশেদপুরে এক নিয়ম আর এখানে অন্য রকম!” কালীঘাট এমএস প্রথম দু’টো ম্যাচে ৮ গোল খেয়েছে। লাল-হলুদ কোচ চাইছেন, সেটা আরও বাড়িয়ে দিতে। “আমাদের জিততে হবেই এবং বেশি গোলে। অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই,” সুইমিং পুল থেকে ফিরে বলছিলেন মর্গ্যান। তীব্র চাপ থেকে বেরিয়ে ওএনজিসি ম্যাচ জেতার পরও যথেষ্ট চিন্তিত তিনি। তবে যে টিমকে কলকাতা লিগে উড়িয়ে দিয়েছিলেন চার গোলে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদার সেই দলকে খাটো করে দেখতে নারাজ ইস্টবেঙ্গল কোচ। “হ্যালকেও একবার আই লিগে অ্যাওয়ে ম্যাচে আমরা আট গোল দিয়েছিলাম। পরে হোম ম্যাচে ওদের হারাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল।”
টুর্নামেন্ট শুরুর মুখে যে ইস্টবেঙ্গল টিমকে দেখে মনে হচ্ছিল, অশ্বমেধের ঘোড়া, দু’টো ম্যাচের পর তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে বেশ চাপে। মর্গ্যানও স্বীকার করলেন, “চাপ তো একটা আছেই। কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই তো আমরা কাল খেলব।” খাবরা কার্ডের জন্য বাইরে। তবে দলে ফিরছেন মেহতাব। মর্গ্যান বারবার বললেন, “আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলব। তার জন্য যা করার করব।” যে জন্য দলে ঢুকতে পারেন সঞ্জুও।
তাঁর দল ইস্টবেঙ্গলকে ম্যাচ ছেড়ে দিতে পারে, গোল-সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারে, স্পোর্টিং ক্লুবের তোলা অভিযোগে ক্ষুব্ধ কালীঘাটের কোচ অরুণ ঘোষ। বললেন, “কোনও প্রশ্নই নেই। আমাকে কেউ কোনও অনুরোধও করেনি। আমাদের লক্ষ্য ফেড কাপ থেকে অন্তত একটা পয়েন্ট নিয়ে ফেরা।” তার পর যোগ করলেন, ওদের আসল প্লেয়ার হল পেন। ওর পিছনে আমাদের সুকান্ত মণ্ডলকে লাগাব।” কথা বললে বোঝা যায় ‘গড়াপেটা’ কোনও গন্ধ নেই কালীঘাটে। বরং লড়াই দিতে প্রস্তুত।
কালীঘাট কতটা লড়াই দেবে তার উপর নির্ভর করছে মর্গ্যানের টিমের ভবিষ্যৎ। চিডি-মননদীপরা অবশ্য আজই মাঠে এসে শেষ চারের প্রতিপক্ষ চার্চিল ব্রাদার্সকে মেপে গেলেন।
|
নেই-রাজ্যে ফেড কাপ |
কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম
• মাঠ চাপড়া ঘাস, কোথাও আবার ঘাসই নেই। কাদা শুকিয়ে অসমান। মাঠে ক্রিকেটের পিচ। দৌড়তে গিয়ে পেশিতে টান ধরছে ফুটবলারদের।
• ড্রেসিংরুম দিনে দু’টো করে ম্যাচ পড়ায় চার দলের জন্য ড্রেসিংরুম দুই। এক দল না বেরোনো পর্যন্ত ঢুকতে পারছে না অন্য দল।
• রেফারিদের ঘর ড্রেসিংরুম লাগোয়া, যা ফিফার নিয়ম মেনে নয়।
• গ্যালারি ভিভিআইপি এবং ভারতীয় কোচ কোভারম্যান্সকেও বসতে হচ্ছে ম্যারাপের নীচে। |
সীমা সুরক্ষা বলয় মাঠ
• মাঠ অসমান বাউন্স, ঘাস ঠিক ভাবে ছাঁটা নেই, কাদায় ভরা, জাতীয় মানের টুর্নামেন্ট করার অযোগ্য।
• রিজার্ভ বেঞ্চ মাঠে কোনও রিজার্ভ বেঞ্চ বলে বস্তু নেই। চেয়ার লাগিয়ে অস্থায়ী রিজার্ভ বেঞ্চে বসবে দুই টিম।
• ড্রেসিংরুম কোনও ড্রেসিংরুম নেই। মাঠ থেকে দূরে দু’টি ঘরে অস্থায়ী ড্রেসিংরুম করার চেষ্টা চলছে। ফুটবলারদের জন্য শৌচাগার বা পানীয় জলের স্থায়ী ব্যবস্থা নেই।
• রেফারিদের ঘর ড্রেসিংরুমের মতোই নেই রেফারিদের ঘরও।
• গ্যালারি পঞ্চাশ-একশো আসনের দু’টি ছোট ছোট গ্যালারি। গ্যালারিতে সাধারণ দর্শকদের প্রবেশ নিষেধ। |
|