দুটি প্রতিবেশী দেশ যদি দ্রুত উন্নয়নশীল হয়, তবে তারা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। ভারত এবং বাংলাদেশও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। এই দেশদুটি তাদের আর্থিক যোগাযোগকে নিবিড়তর করে তুলে পরস্পরের বড় বাজার, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বর্ধিত চাহিদার ফায়দা নিতে পারে। সম্প্রতি ভারত এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে অনেকগুলি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধিতে এই চুক্তিগুলিও সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে, আসিয়ানের সঙ্গে ভারতের যে যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে, তার পথ বাংলাদেশ ও মায়ানমার হয়েই যাবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সঙ্ঘবদ্ধতা গড়ে তোলার এ এক বড় সুযোগ।
গত তিন বছরে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বেশ ভাল বার্ষিক ছয় শতাংশের ঊর্ধ্বে। সে দেশে ২০১১ সালে শিল্প-উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় দশ শতাংশ। ক্ষুদ্র শিল্পগুলি এই বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বস্ত্র, চর্মজাত এবং পাটজাত পণ্যের রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ বেশ সুনাম অর্জন করেছে। ২০১২ অর্থবর্ষের প্রথম অর্ধে বাংলাদেশের রফতানি ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার ছিল ২৯ শতাংশ। এই বিপুল বাজার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের দৌলতে ভারতের বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশে লগ্নি করা ক্রমেই একটি লাভজনক সম্ভাবনা হয়ে উঠছে।
গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে এবং তার পরের বছর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের প্রসঙ্গটি বার বার ফিরে এসেছে। সামান্য কয়েকটি পণ্য বাদ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানিকৃত কোনও পণ্যের ওপর ভারত আমদানি শুল্ক আরোপ না করার সিদ্ধান্ত করেছে। দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত সহজতর করার লক্ষ্যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। অন্য দিকে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছেন, ভারতকে চট্টগ্রাম এবং মঙ্গলা বন্দর ব্যবহারের অধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, আশুগঞ্জ বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত করা হবে। অর্থাৎ, উভয় পক্ষই আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে উদগ্রীব। |
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক গত কয়েক বছরে অতি দ্রুত হারে বেড়েছে। ২০০৬-০৭ সালে দুই দেশের মোট পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮০ কোটি ডলার। ২০১১-১২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৩০ কোটি ডলার। ভারত থেকে বাংলাদেশে তুলো, ভোজ্য তেল, গাড়ি, লৌহ-ইস্পাত, খনিজ জ্বালানি, খাদ্যশস্য, জৈব রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি রফতানি করা হয়। বাংলাদেশ ভারতে কাগজ, কাপড়, মাছ, সিমেন্ট, তামা, অজৈব রাসায়নিক পদার্থ, সার ইত্যাদি রফতানি করে। ভারতের বেশ কয়েকটি নামকরা বাণিজ্যিক সংস্থা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে।
যদিও বাণিজ্যের পাল্লা এখনও ভারতের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আমদানির পরিমাণ বাড়লে এই বাণিজ্য অনেক বেশি সুস্থায়ী এবং ভারসম হবে। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লে এই প্রক্রিয়া গতি পাবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্র প্রচুর বিদ্যুৎ, টেলিকম ইত্যাদির পরিকাঠামো নির্মাণ থেকে জাহাজ নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন, স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রই ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে তৈরি।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রচুর কারিগরী শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সবেতেই বিনিয়োগ সম্ভব। পরিবেশের ক্ষেত্রেও ভাল সুযোগ রয়েছে। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, জল পরিশোধন, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বায়ু দূষণ প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে অনেক খামতি রয়েছে। বিদ্যুৎ, সড়ক, বন্দর, জলপথ, রেলপথ সব ক্ষেত্রেই ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের সুযোগ রয়েছে। এই ক্ষেত্রগুলিতে বাংলাদেশ সরকার ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছে।
শিল্প-উৎপাদন ক্ষেত্রে ভারত রেডিমেড বস্ত্র ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কথা ভাবতে পারে। এই ক্ষেত্রটি থেকেই বাংলাদেশের মোট রফতানির তিন-চতুর্থাংশ আসে। ফার্মাসিউটিক্যালসও বাংলাদেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বনির্ভর হতে চায়। ভারত কাঁচামাল এবং যন্ত্র সরবরাহ করে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে।
এখনও বাণিজ্যিক সফরের জন্য ভিসা বা প্রযুক্তিগত মানের মাপকাঠির মতো কিছু বিষয়ের জট ছাড়ানো বাকি আছে। তবে, দুই দেশের সরকারই এই বিষয়গুলির দ্রুত নিষ্পত্তি চায়। দুটি দেশই যাতে পরস্পরের গুণগত মান যাচাইয়ের শংসাপত্রে বিশ্বাস করে, তার জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছে। পরীক্ষাগারগুলির মান উন্নয়নের জন্যও আলোচনা চলছে।
ভারতের একটি প্রধান বণিকসভার মহানির্দেশক হিসেবে আমি জানিয়ে রাখতে চাই যে ভারতের বাণিজ্যমহল বাংলাদেশের আর্থিক ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অতি আশাবাদী এবং এই দ্রুত উন্নয়নশীল দেশটির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতে চায়। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আর্থিক সহযোগিতার এক নতুন যুগের অপেক্ষায় রয়েছি।
|