মারাত্মক উক্তি, সর্বনেশে উক্তি! প্রেসিডেন্সি কলেজ বাদ দিয়ে বঙ্গভূমির অস্তিত্ব যদি কল্পনা করাও সম্ভব না হয়, তা হলে খোদ রবীন্দ্রনাথই তো বঙ্গভূমি থেকে বরবাদ। ভদ্রলোকটি যখন বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন, মনে হয় না আগু-পিছু তেমন কিছু ভেবেচিন্তে বলেছিলেন। ব্যাকুলতার মুহূর্তে আমরা এমন কথা মাঝেমধ্যে বলে ফেলি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অবশ্য দাবি করেছিলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’, এবং অতি সম্প্রতি এক মুখ্যমন্ত্রী সদর্পে ঘোষণা করেছেন, তিনি যে আশ্চর্য ভাল রাজ্য প্রশাসন চালাচ্ছেন, পৃথিবীতে কেউ তার ধারে কাছেও আসতে পারে না। তবে সব দেশের স্বদেশি গানেই একটু বাগাড়ম্বর থাকে, আর মুখ্যমন্ত্রীকে সম্ভবত বোঝানো হয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীর মূল মন্ত্রোচ্চারণই হচ্ছে: ‘হমারা চিজ সবসে আচ্ছা হ্যায়!’
সমস্যা দেখা দেয় যখন এ-ধরনের আবেগ-বাষ্পকে শাস্ত্রীয় সম্মান জ্ঞাপন করে উপাসনা শুরু হয়ে যায়। তা হলেই ওই প্রয়াত মনীষীর স্নেহধন্য এবং ততটা-স্নেহধন্য-নন’দের মতো শ্রেণিবিভাজনের উৎসমুখ অবারিত হয়। যেমনটা ঘটেছে প্রেসিডেন্সি কলেজকে কেন্দ্র করে। যেহেতু ওই অধ্যাপকের উক্তিটি এক বার চালু হয়ে গেছে, প্রেসিডেন্সি কলেজ যেন মহীরুহের মতো এক পাশে একা দাঁড়িয়ে বঙ্গভূমির আত্মা ও নিয়ামক, বাকি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধম শ্রেণিভুক্ত, তাদের দিকে তেমন নজর না-দিলেও চলবে। শুধু শিক্ষকসম্প্রদায়-ভুক্ত মান্যগণ্যরাই নন, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক, রাজপুরুষ ইত্যাকার বিভিন্ন বৃত্তিতে নিমগ্ন বরেণ্য বাঙালি ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও বরাবরই অনেকে প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী। সুতরাং কলেজটির সম্ভ্রান্ত থেকে সম্ভ্রান্ততর পরিচর্যার সমর্থনে ‘জনমত’ তৈরি করতে সময় লাগেনি। খবরের কাগজে ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে ঘন ঘন আলোচনা হতে থাকলেই তো তা জনমতের সমার্থক বলে সাধারণত ধরে নেওয়া হয়। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মূক মুখগুলি এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে না, অংশগ্রহণের ক্ষমতাই তাদের নেই। তা ছাড়া যে বিষয় তাদের জ্ঞানগম্যির বাইরে, তা নিয়ে তাদের কী-ই বা বলবার থাকতে পারে?
সুতরাং প্রেসিডেন্সি কলেজের হয়ে যাঁরা শ্রেণিযুদ্ধ লড়েছিলেন, তাঁরা অনেকটাই জয়ী হলেন। ‘সব কলেজ সমান, কিন্তু প্রেসিডেন্সি একটু বেশ সমান’, এই নীতি মেনে নিল রাজ্য সরকার। কলেজটির বিভিন্ন বিভাগে উৎকর্ষ-কেন্দ্র খোলার ব্যবস্থা হল। তার সঙ্গে কলেজের পরিকাঠামো প্রসারের বিভিন্ন উদ্যোগ। প্রেসিডেন্সির ব্যয়বরাদ্দ অনেকটা বাড়ল। কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের ব্যবস্থা প্রসারিত হল। অভিজাত কলেজ ক্রমশ অভিজাততর। পাশাপাশি বাছাই-করা অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের নিয়োগ। সেই সঙ্গে এটাও ঐতিহ্যে দাঁড়িয়ে গেল এবংবিধ মহৎ শিক্ষাবিদরা, যাঁরা প্রেসিডেন্সি আলো করে আছেন, তাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজেই থেকে যাবেন। তাঁদের অধ্যাপনা তপশ্চর্যার বিঘ্ন ঘটানো হবে না। তাঁরা অবসর না-নেওয়া পর্যন্ত ওই অভিজাততম প্রতিষ্ঠানেই অবিচল থেকে যাবেন, তাঁদের কোচবিহার বা কৃষ্ণনগর বদলি করার মতো ঔদ্ধত্য তথা নির্বুদ্ধিতা সরকার প্রদর্শন করবে না। ফলে, ছাত্রছাত্রীদের কাছেও প্রেসিডেন্সির আকর্ষণ বহু গুণ বেড়ে গেল। তবে সেই সঙ্গে শ্রেণিবিভাজনও একটু-একটু করে ক্রমবর্ধমান। ইংরেজ আমলে, এমনকী সাহেব অধ্যাপকদেরও চট্টগ্রাম-ঢাকা-রাজশাহি-কৃষ্ণনগর বদলি করা হত, অথচ স্বাধীন ভারতে নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল এক বার কোনও ক্রমে প্রেসিডেন্সির শিক্ষক তালিকায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে চিরকালের জন্য নিশ্চিন্ত আশ্রম। এক দিকে যেমন কোনও-কোনও ক্ষেত্রে পরিতৃপ্তির আলস্য-জড়ানো আমেজ, সেই সঙ্গে বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে ঈষৎ নাক-সিঁটকোনোর সঞ্চার, প্রাঙ্গণে যাঁরা ঢুকতে পারলেন না, তাঁদের পরশ্রীকাতরতার সঙ্গে
যুক্ত হল এক ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা অনেকের মনে।
যাঁরা সমাজের সর্বত্র সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছেন, এই বিশেষ প্রেসিডেন্সি-ভজনা তাঁদের বিচারে ঘোর আদর্শ-বিরোধী। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঘাতপ্রতিঘাত কে ঠেকাবে? রাজ্য প্রশাসনের রাজনৈতিক রং পাল্টানোর ঋতুতে একটি বিচিত্র মিলনমেলার সূচনা হল। সমতায় বিশ্বাসী আদর্শবাদীরা অবশ্যই সরব, কিন্তু তাঁদের সঙ্গ দিচ্ছেন এমনকী নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক দঙ্গল মাঝারি মেধার চতুরালি-সর্বস্ব মানুষ, যাঁদের একমাত্র পুঁজি ঘোঁট পাকানোর প্রতিভা। এরই কিছু দিন আগে অবশ্য বেশ কিছু উজ্জ্বল প্রতিভাসম্পন্ন বাচ্চা ছেলেমেয়ে মাও জে দঙের রক্তগ্রন্থে শপথ নিয়ে গোটা ধনতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্সি কলেজের উঠোন জুড়ে উত্তাল ঝোড়ো হাওয়া তুলে হঠাৎই ফের মিলিয়ে গিয়েছে। তবে তাদের বিদ্রোহে হাজার বিভ্রান্তি সত্ত্বেও যে নির্মাল্য ছিল, কয়েক বছর বাদে আসরে অবতীর্ণ কুচুটেদের চিন্তায় আচরণে বিচরণে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি, সংকীর্ণ মানসিকতা, কী করে নিজেদের উত্তম করে তোলা যায় তা নিয়ে ভাবনা নেই, অন্যদের কী করে টেনে নামানো যায় তা-ই একমাত্র আরাধ্য বিষয়। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্য স্থাপনের সদর্থ নিকৃষ্টের সাম্রাজ্য বিস্তার নয়, উৎকর্ষের ব্যাপ্ততম প্রকাশ; এই সোজা সত্যটুকু তাঁদের গজাল মেরে বোঝানোও সম্ভব হল না। পরিণাম সর্বনেশে। তাঁদের মধ্যে একজন দু’জন হয়তো নিজেদের জন্য খানিক বাড়তি ঘি-টুকু ছানা-টুকু সংগ্রহ করতে সফল হলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পশ্চিমবঙ্গের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটি নিরেট মালিন্যের বোঝা চাপল; যে-আদর্শকে ঢাল করে ওই সুবিধাবাদীরা যুদ্ধের অভিনয়ে নেমেছিলেন, তার গায়ে কালি ঢালা হল। ফের যে রাজ্য রাজনৈতিক পালাবদল, তার অন্যতম কারণ নিশ্চয়ই এই অবিমৃশ্যকারীদের অমিতাচার।
নতুন জমানায় প্রেসিডেন্সি-বন্দনা আপাতত ঊর্ধ্বশ্বাসে উচ্চতম মার্গগামী। কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রারম্ভিক ব্যবস্থাপনা অবশ্য পূর্বতন সরকারই সম্পন্ন করে গেছে, কিন্তু এখন বিপুল সম্ভার-সহ যে ধরনের রাজসূয় যজ্ঞ নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তাতে দিন-আনা-দিন-খাওয়া বাঙালির চোখ ছানাবড়া। সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী, তাতে কী! প্রায় সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না, তাতে কী! অর্থের অনটন হেতু অনেক সরকারি পদের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ বন্ধ, অর্থাভাবে সরকারি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম, পরিবহণ ব্যবস্থারও তথৈবচ দশা, তাতে কী! প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তনী বিদেশে নানা বিখ্যাত শিক্ষা অথবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ঘর আলো করে আছেন, সেই সঙ্গে দেশেও যাঁরা মুখোজ্জ্বলকারী বিভিন্ন কর্তব্যে ব্যাপৃত, তাঁদের থেকে বাছাই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মন্ত্রণাগোষ্ঠী গঠন করা হয়েছে। তাঁদের দায়িত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে মন্ত্রণামণ্ডলীর সদস্যবৃন্দ সম্পূর্ণ অবহিত। তাঁরা আগে কে-বা প্রাণ করিবেক দান কতর্ব্যবোধে অন্য সমস্ত কাজ ফেলে কলকাতায় জড়ো হচ্ছেন, নিত্যনতুন পরামর্শের ফর্দ তৈরি করছেন, কী করে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ড, ইয়েল-কেও ছাপিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে সতত শলাপরামর্শ দিচ্ছেন। জলের মতো টাকার স্রোত বয়ে যাবে, এমনধারা নানা কার্যাবলির নিদান প্রতিদিন জমা পড়ছে, পড়ে মরুকগে তাদের সমস্যা নিয়ে রাজ্যের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। পড়ে মরুকগে কলকাতায় ও জেলায় জেলায় ছড়ানো কলেজগুলি তাদের হাজার সমস্যা নিয়ে। উচ্ছন্নে যাক মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, কিছু যায় আসে না। সব কথা তো বলা-ই হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্সিই বঙ্গভূমি, বঙ্গভূমিই প্রেসিডেন্সি।
তবে সুমহান তীর্থযাত্রাও তো সব ক্ষেত্রে আগাগোড়া কুসুমাস্তীর্ণ নয়! বিবেক দংশন হেতু প্রেসিডেন্সির মন্ত্রণা পরিষদের অন্যতম সদস্য ইতিমধ্যেই ইস্তফা দিয়েছেন। তাঁর মনস্তাপ, শুধু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কেন এগিয়ে যাবে। কেন কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুরূপ তোফা ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হবে না, কেন প্রেসিডেন্সিই একা ছড়া কাটবে: ‘আমরা যাব জাম্তাড়াতে চড়ব কেমন ট্রেইনে,
চেঁচাও যদি ‘সঙ্গে নে যাও’ বল্ব ‘কলা এইনে’!’
কেন অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় এমন শৌখিন রেলভ্রমণে সহযাত্রী হতে পারবে না?
ভয়ে-ভয়ে, যথেষ্ট হীনম্মন্যতা নিয়ে, নিবেদন করছি, মন্ত্রণা পরিষদ থেকে পদত্যাগী সদস্য মহাশয় এখনও ঠিক শ্রেণিবিযুক্ত হতে পারছেন না। মনে হয় তিনি শ্রেণিবিভাজনের বিপক্ষে নন, শুধু কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অতি বিশেষ মর্যাদাভুক্ত করতে চাইছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যত্র কী ঘটছে বা ঘটবে তা নিয়ে এখনও তিনি যেন তেমন বিচলিত নন। মন্ত্রণামণ্ডলীর পক্ষ থেকে সম্ভবত বলা হবে, তাঁদের তো শুধু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ বিধান নিয়ে চিন্তাকুল হতে বলা হয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্র তথা রাজ্যের অন্যান্য সমস্যাদি নিয়ে ভাবা তাঁদের এক্তিয়ারের বাইরে। তাই কী? তাঁদের বিবেচনায় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে দেশে-সমাজে-পরিপার্শ্বে সম্ভাব্য ঘটনাবলির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, অন্য সর্বত্র মহাপ্রলয় ঘটে
গেলেও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু যাবে-আসবে না, তাঁরা মহাপ্রলয়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এগিয়ে যাবেন?
তবে উতলা হয়ে লাভ নেই। সমর সেন তো সেই কবে লিখে গেছেন, ভুলে হোক ভ্রান্তিতে হোক, উৎকণ্ঠায় হোক, নতুন চেতনার ছাপ কোনও না কোনও এক দিন আমাদের আচ্ছন্ন করবেই, ঠেকে শিখি আমরা। |