সীমান্তের দুই পারে দুই দেশের মানুষ একই ভাষায় কথা বলেন, একই গান করেন: মনে করাইলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের ভারতীয় হাই-কমিশনারের নিকট তাঁহার এই মন্তব্য। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য একটি কথা বলিতে ভুলিয়া গেলেন। বলিলেন না যে, সীমান্তের দুই পারে কিন্তু আপাতত একটি বড় রকমের বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান: ওই পারে অগ্রগতির আরাধনা, এই পারে পশ্চাৎপরতার জয়গান। ওই পারের নেত্রী সম্মুখের দিকে চলিতেছেন। এই পারের নেত্রী পশ্চাৎপরতাকে বরণ করিতেছেন। দেশের উন্নয়নে বাধা আসিলে বাংলাদেশের শীর্ষনেত্রী তাহা পার হইতে যথাসম্ভব, এমনকী অসম্ভব, প্রচেষ্টাতেও দ্বিধাগ্রস্ত নহেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নের পথে নিজেই বাধা আমদানিতে ব্যস্ত। প্রমাণ? বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাংশকে যুক্ত করিবার লক্ষ্যে পদ্মানদীর উপর সাড়ে ছয় কিলোমিটার-ব্যাপী যে সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাঙ্ক বাংলাদেশকে প্রথমে ১২০ কোটি ডলার সহায়তাদানে প্রথমে রাজি হইয়াও পরে সরকারি দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিশ্রুতি হইতে সহসা সরিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত লইয়াছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাঙ্ককে আবার সফল ভাবে ফিরাইয়া আনিয়াছেন। বিশ্বব্যাঙ্কের অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ তদন্ত করিতে রাজি তিনি, অভিযুক্ত সমস্ত সরকারি মন্ত্রী ও আমলাবর্গকে সেতুর কাজ চলাকালীন ছুটিতে পাঠাইয়া দিবার শর্তেও তিনি রাজি। সেতু নির্মাণের লক্ষ্যটিই তাঁহার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। এমন নেত্রী দৃষ্টান্তযোগ্য। দুর্ভাগা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে চরম ঈর্ষণীয়।
কেবল এই বিশেষ সেতুটির ক্ষেত্রেই নয়। প্রবল রাজনৈতিক বিরোধিতা ও বিবিধ বাধাবিপত্তির মধ্যেও শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা দৃঢ় ভাবে ‘উন্নয়ন-স্তম্ভ’ নির্মাণের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হইতেছে। এই উন্নয়ন-স্তম্ভের অর্থ কী? অর্থ: যথাশীঘ্র কর-রাজস্ব সংগ্রহের ঘাটতি পূর্ণ করা, রাজস্ব ঘাটতি মিটানো, পেট্রোল ও পেট্রো-পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক মানের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, এবং সামাজিক সুরক্ষার জালটিকে যথাসম্ভব প্রসারিত করা। স্বভাবতই, বিরোধীরা প্রবল তেজে জনস্বার্থ-বিরোধিতার অভিযোগ আনিতেছেন, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে সরকারকে ঠেলিয়া দিতেছেন। হাসিনা কিন্তু দক্ষ ভাবে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করিতেছেন। এ মাসের গোড়ায় পার্লামেন্টে বলিয়াছেন, বিশ্ব ব্যাঙ্কের সহায়তা প্রত্যাহারের মধ্যেই জাতীয় অবমাননা, জাতীয় দুর্দশা বৃদ্ধির সম্ভাবনা। অন্য দিকে, মন্ত্রী-আমলাদের ছুটিতে পাঠাইয়া বিদেশি ঋণ প্রবেশের ঝুঁকিপূর্ণ পথটি লইতেও ‘জাতীয়তা’র তোয়াক্কা করেন নাই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঝুঁকি লইতে জানেন। তবে তাহা কেবলই নির্বাচনী রাজনীতির ঝুঁকি। সেই এক ও একক জনমোহিনী নির্বাচনী ভাবধারার কারণেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ঝুঁকি গ্রহণ তাঁহার পক্ষে অভাবনীয়। তাই তাঁহার রাজ্যে বিদেশি লগ্নি তো দূরস্থান, দেশি লগ্নিও ফিরিয়া তাকায় না। জমির প্রশ্নেই হউক, আর বিদেশি লগ্নির প্রশ্নেই হউক, স্বল্পমেয়াদি ত্যাগ বা সমঝোতার মাধ্যমেই যে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে রাজ্যকে টানিয়া লওয়ার একমাত্র আশা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাহা বোঝেন না, বুঝিবেন না। সমস্ত সুযোগ ও সুপরামর্শ তাঁহার অটল জেদ ও সংকীর্ণ রাজনীতি-দর্শনের যূপকাষ্ঠে মাথা কুটিয়া মরে। সীমান্তরেখার দুই পারে এই বৈসাদৃশ্যের ফলাফল? ওই বাংলা আজ যাহা ভাবে, এই বাংলা এক দশকেও তাহা ভাবিয়া উঠিতে পারিবে না। |