ইহা কি স্বপ্ন? ইহা কি সত্য? যে ‘সাম্প্রদায়িক’ বি জে পি-কে গাল না পাড়িয়া বামপন্থীদের কোনও সভা আরম্ভ হয় না, সেই দলের সহিত একই মঞ্চে উপবিষ্ট সি পি আই এম-এর শীর্ষনেতা! যে সি পি আই এম-এর সমর্থককে চায়ের দোকানে দেখিলে দলীয় কর্মীদের মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যাওয়ার ফরমান দেওয়া আছে, সেই সি পি আই এম-এর ডাকা বন্ধ সফল করিবার জন্য মানুষকে অভিনন্দন জানাইতেছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! তবে কি যে অলীক মহাজোটের অনেক গল্প বঙ্গবাসী কার্যত জন্ম ইস্তক শুনিয়া আসিতেছে অথচ যাহাকে কখনও চোখে দেখে নাই, তেমনই আর এক অলীকতর মহাজোটের সূচনার শুভ মুহূর্ত সমাগত? বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিলে ছবিটি অতীব সরল। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সংস্কারের পথে পা ফেলিয়াছেন। সংস্কারবিরোধীরা এক নৌকায় সওয়ার হইবেন তো বটেই! যদি কেহ ইতিহাস ঘাঁটিয়া প্রশ্ন করেন, তবে যে এন ডি এ-র সরকারে বিলগ্নীকরণের জন্যই একটি পৃথক মন্ত্রক ছিল? এক বাক্যে উত্তর: তখন বি জে পি শাসক ছিল, এখন বিরোধী। সংস্কারের বিরোধিতায়, অতএব, তাহাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। বামপন্থীরা জন্মসূত্রে সংস্কারবিরোধী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীতর। কাজেই মহাজোট হইয়াছে। বামফ্রন্ট, বিজেপি, তৃণমূল-এর মহাজোট।
তৃণমূল কংগ্রেস বামপন্থীদের সংস্কার-বিরোধিতার কেতাবটি সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করিয়াছে। ফলে, সি পি আই এম যাহা বলিত, বলে এবং বলিতে পারে, সবই তৃণমূল কংগ্রেস বলিয়া ফেলিয়াছে। পালের হাওয়া ফিরাইয়া আনিতে সি পি আই এম-এর হাতে একটি অস্ত্রই অবশিষ্ট আছে সংস্কার-বিরোধিতার সুরটি তৃণমূলের অপেক্ষায় চড়ায় বাঁধা। বামপন্থীরা সুর চড়াইতেছেন। বি জে পি-র কাছে ইহা ঘোলা জলে ভোট ধরিবার সুযোগ। ফলে, পশ্চিমবঙ্গে সংস্কারের বিরুদ্ধে ঝোড়ো হাওয়া বহিতেছে। হাওয়া সত্য, হাওয়ার দাপট আরও সত্য। সেই হাওয়ার মুখে যে দলটি দাঁড়াইয়া আছে, তাহার নাম কংগ্রেস। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সংস্কারের পথে হাঁটিয়াছেন, ফলে সংস্কারের দায় অস্বীকার করিবার সুযোগ তাহাদের নাই। তৃণমূল কংগ্রেসের চাপে দলটি রাজ্যে কার্যত সাইনবোর্ডসর্বস্ব। সংস্কার-বিরোধিতার ঝড়ে সেই সাইনবোর্ডও কি উড়িয়া যাইবে? না কি, এই হাওয়াতেই কংগ্রেসের নিকট রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবার সুবর্ণসুযোগ ভাসিয়া আসিয়াছে?
সুবর্ণসুযোগই বটে। রাজ্যে কংগ্রেস যত বারই তৃণমূলের সহিত সম্মুখসমরে নামিবার কথা ভাবিয়াছে, হাইকম্যান্ড তাহাতে জল ঢালিয়াছে। তাহাতে দীপা দাশমুন্সি বা অধীর চৌধুরীদের ক্ষোভ বড় কম নহে। এত দিনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করিবার একটি সুযোগ প্রদেশ নেতৃত্ব পাইয়াছেন, যাহাতে হাইকম্যান্ড তাঁহাদের পার্শ্বে। কাজেই, সেই প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করিলে হাইকম্যান্ড আপত্তি করিবে না। পঞ্চায়েত নির্বাচন আসিতেছে। তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ হইতে কংগ্রেসের নামগন্ধটুকুও মুছিয়া ফেলিতে সর্বাত্মক লড়িবে, কারণ কংগ্রেস না থাকিলেও তাহাদের কিছু আসিয়া যায় না, এই কথাটি প্রমাণ করিবার দায় তাহাদের আছে। প্রদেশ কংগ্রেসের কর্তব্য প্রত্যাঘাতের পথে হাঁটা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্কার-বিরোধিতায় যে রাজনৈতিক সুবিধাবাদেরই প্রাধান্য, মা-মাটি-মানুষের স্বার্থরক্ষার তাগিদ তেমন নাই, ইহা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য প্রসঙ্গটি তুলিয়াছেন। সদ্য-প্রাক্তন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াও ছাত্র ও যুব কংগ্রেসের কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করিতেছেন বিদেশি পুঁজির গুণাগুণ ব্যাখ্যা করিতে। প্রদেশ নেতৃত্ব ঠিক পথ বাছিয়াছেন। আর্থিক সংস্কার যে মানুষের ভালই করিবে, তাহা সন্দেহাতীত। সেই ভালটি মানুষকে বুঝাইতে পারিলে এ রাজ্যে কংগ্রেসের মৃতসঞ্জীবন হওয়ার সম্ভাবনা। |