দিল্লি বলছে, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারে। তাই রাজ্য পুলিশই এর ভার নিক।
শুনে রাজ্যের প্রশ্ন: তা কেন? কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া আর কার?
সুরক্ষার দায়ভার নিয়ে দুই সরকারের এ হেন চাপান-উতোরের মাঝে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে নিতান্ত অবহেলায় ও কার্যত অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত সম্পদের সম্ভার। সেখানে প্রহরার যা ফাঁক-ফোকর, তাতে আবার যে কোনও দিন ‘নোবেল চুরি’র মতো কাণ্ডও ঘটে যেতে পারে বলে রাজ্য ও কেন্দ্রের একাধিক নিরাপত্তা এজেন্সির রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক যাকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করছে, বিশ্বভারতীর সেই উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি বাড়ি। আছে রবীন্দ্রভবন ও রবীন্দ্র-সামগ্রীর সংগ্রহশালা। উল্টো দিকে নন্দন চত্বর, উপাসনাগৃহ বা কাচঘর এবং শান্তিনিকেতন গৃহ। লাগোয়া কলাভবনের মিউজিয়ামেও বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য শিল্পকর্ম ও রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী মজুত। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য বিতণ্ডায় এ সবের রক্ষাকর্তা কে হবে, তার ফয়সালা হচ্ছে না। উল্লেখ্য, উত্তরায়ণ থেকেই চুরি যাওয়া নোবেল আজও উদ্ধার হয়নি।
উত্তরায়ণের বেহাল নিরাপত্তা সম্পর্কে বছর দেড়েক আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তদানীন্তন উপাচার্য। তাঁর আর্জি ছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অবিলম্বে ওখানকার সুরক্ষার ভার নিক। কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর: ওঁর চিঠিতে এমন কিছু ‘বিস্ফোরক’ তথ্য ছিল, যা দেখে চমকে ওঠেন দিল্লির কর্তারা। তখনই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনীকে বলা হয়েছিল বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে (সিকিওরিটি অডিট) রিপোর্ট দাখিল করতে। |
সেই মতো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদল গোপনে বিশ্বভারতী ঘুরে গিয়ে নর্থ ব্লকে রিপোর্ট দেয়। তাতে বলা হয়, প্রাক্তন উপাচার্যের অভিযোগ-উদ্বেগের যথেষ্ট ভিত্তি আছে। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসম্পদ যে ভাবে অনাদরে পড়ে রয়েছে, তাতে আবার যে কোনও মুহূর্তে বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে, এমনকী নোবেল পদকের মতো আরও কিছু সামগ্রী উধাও হয়ে যাওয়াও আশ্চর্য নয় বলে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছিল। রিপোর্টটি পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মহাকরণে চিঠি পাঠায়। তাতে পুরো পরিস্থিতি জানিয়ে উত্তরায়ণের নিরাপত্তায় রাজ্য পুলিশকে বহাল করার অনুরোধ জানানো হয়। যুক্তি দেওয়া হয়: আইন-শৃঙ্খলা যে হেতু একান্ত ভাবে রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়, তাই শান্তিনিকেতনের নিরাপত্তা দেখাও রাজ্যের দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে।
কেন্দ্রের চিঠি পেয়ে বীরভূম জেলা পুলিশের কাছে বিশ্বভারতীর বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট চায় মহাকরণের স্বরাষ্ট্র দফতর। বীরভূম পুলিশ নিরাপত্তায় ‘ত্রুটি-বিচ্যুতি’র কথা মেনে নিলেও কোনও রকম দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। জেলা পুলিশ জানায়, উত্তরায়ণের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে আরও পাঁচশো কর্মী-অফিসার প্রয়োজন, যা পাওয়া মুশকিল। বীরভূমের পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনার কথায়, “আমাদের হাতে এত পুলিশ নেই। মহাকরণকে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।” এসপি এ-ও বলেন, “বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং কেন্দ্রীয় শিল্প-নিরাপত্তা বাহিনী (সিআইএসএফ)-ই তো কাজটা করতে পারে!”
স্বরাষ্ট্র দফতরও জেলা পুলিশের বক্তব্য মেনে নিয়েছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিকে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য পুলিশের পক্ষে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণের সার্বিক নিরাপত্তার (সিকিওরিটি অ্যাকসেস কন্ট্রোল) ভার নেওয়া সম্ভব হবে না। তবে যতটুকু সম্ভব, করা হবে। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার অভিযোগ, “উত্তরায়ণ-সহ গোটা শান্তিনিকেতনে নিরাপত্তা বেআব্রু। সিআইএসএফের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়াটা তো তিন মিনিটের ব্যাপার! অথচ তা না-করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বভারতীর নিরাপত্তার ভার রাজ্যের ঘাড়ে ঠেলতে চাইছে দিল্লি!” ওই কর্তার মন্তব্য, “ওখানে ফের বিভ্রাট ঘটলে রাজ্য পুলিশই অপদস্থ হবে। তাই আমাদের দাবি, দিল্লি নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব নিক। রাজ্য সরকার সহযোগিতা করবে।”
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কী চাইছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র অমৃত সেন বলেন, “উত্তরায়ণের নিরাপত্তা নিয়ে আমরাও ঊদ্বিগ্ন। কেন্দ্র ও রাজ্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। আমরা চাই, প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা দু’টো দিক খতিয়ে দেখে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।”
|
সাত কাণ্ড |
১৯৯৮ |
কাচঘরে মদের বোতল, ব্যবহৃত কন্ডোম |
২০০৪ |
নোবেল পদক-সহ পঞ্চাশটি সম্পদ চুরি |
২০০৪ |
উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণ থেকে চন্দন গাছ লোপাট |
২০০৯ |
সঙ্গীত ভবনের ছাত্রীকে খুন করে যুবক আত্মঘাতী |
২০০৯ |
ছিনতাইবাজদের গুলিতে জখম দুই ইরানি ছাত্র |
২০১০ |
শিক্ষকদের পক্ষকালব্যাপী হরতাল |
২০১০ |
বসন্তোৎসবের প্রাক্কালে ছাত্র-সংঘর্ষ |
|