হাত বাড়ালে পুলিশ-ফাঁড়ি, সেখানেই লুঠ তিন বাড়িতে
মাঝরাতে নিমতার রামকৃষ্ণ রোডের বাসিন্দা রীতা সাহার ঘুম ভেঙেছিল যাদের ডাকে, তারা সকলেই অপরিচিত। স্পষ্ট মনে আছে, রাতে নিজে দরজায় খিল দিয়ে শুয়েছিলেন। ষন্ডাগুন্ডা চেহারার মুখ-ঢাকা কয়েকটা লোক সটান বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মশারি তুলে বলছিল, ‘আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে হবে না। এ বার ওঠ। আমাদের একটু সাহায্য কর।’ স্বপ্ন ভেবে খানিক্ষণ ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। শেষমেশ পাশে শোয়া স্বামীর গোঙানি আর কান্নামিশ্রিত আওয়াজে রীতাদেবী বুঝতে পারেন, সত্যিই বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে। তাঁর স্বামী ধ্রুববাবুকে বিছানায় বসিয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় দুষ্কৃতীদের এক জন। রীতাদেবীর থেকে চাবি নিয়ে লুঠপাটের পরে রবিবার রাতে ডাকাতদলটি হানা দেয় আরও দু’টি বাড়িতে। রাস্তার আলো নিভিয়ে ভোর পর্যন্ত দফায় দফায় ডাকাতির পরে একটা সাদা গাড়িতে চেপে দুষ্কৃতীদের চলে যেতে দেখেন এলাকার কয়েক জন।
সোনা-রুপোর গয়নার কারিগর ধ্রুববাবু কলকাতার একটি দোকানে কাজ করেন। নিজেদের ছোট বাড়িতে একচিলতে একটা ঘরে স্বামী-স্ত্রী থাকেন। পাশের ঘরে থাকে দুই মেয়ে রিয়া আর পিয়া।
ডাকাতির পরে একটি বাড়িতে। সোমবার নিমতায়। নিজস্ব চিত্র্র
নারকেল তেলের কৌটোয় দুই বোনের টিফিন খরচ বাঁচিয়ে জমানো কয়েকশো টাকাও নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে রীতাদেবী বলেন, “রাতে এক বার বাথরুমে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভেঙে মুখ বাঁধা সাত জনকে ঘরের মধ্যে ঘুরতে দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি। তার পরে ওদের এক জন বাংলায় বলল ‘আমরা ডাকাত। কিছু করব না, যা আছে বার করে দে।’ আলমারি খুলে সব দিয়ে দিলাম। তা-ও গোটা ঘর লণ্ডভণ্ড করল। মেয়েদের কানের দুল থেকে খুচরো পয়সা কিছুই নিতে ছাড়েনি।” প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে লুঠপাটের পরে চিৎকার করলে খুন করার হুমকি দিয়ে বেরিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।
উত্তর নিমতার পাইকপাড়ায় সরু গলির মধ্যে বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী জয়ন্ত ও রনিতা পাত্রের ভাড়াবাড়িতে দুষ্কৃতীরা হানা দেয় রাত দু’টো নাগাদ। গ্রিলের তালা ভাঙার আওয়াজে ঘুম ভেঙেছিল ওই দম্পতির। একটি ঘরে ছ’বছরের ছেলে আলেখ্যকে নিয়ে শুয়েছিলেন তাঁরা। পাশের ঘরে ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। দুষ্কৃতীরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করলে ঘরের ভিতর থেকে জয়ন্তবাবুরা কান্নাকাটি করতে থাকেন। মন গলেনি ডাকাতদের। ধারালো অস্ত্র দিয়ে দরজায় বারবার আঘাত করতে থাকে তারা। রনিতাদেবী বলেন, “দরজা ভেঙে সাত-আট জন ঢুকেই সব জিনিসপত্র ফেলে দিল। বলছিল, অমরেশ নামে কেউ এই ঘরে লুকিয়ে আছে। ওরা খুঁজে দেখবে। বিছানার তোষক, জাজিম উল্টে খুঁজতে শুরু করল। পাশের ঘরে আত্রিকা দত্ত নামে ওই ছাত্রীটি ছিল। জোর করে তার ঘরেও ঢুকল। আমাদের সবার মোবাইল কেড়ে নিল। ওদের কথামতো টাকা, গয়না সব দিলাম। ইমিটেশনের গয়নাও ছিনিয়ে নিল।” রনিতাদেবীরাও জানান, দুষ্কৃতীরা বাংলাতেই কথা বলছিল। ছোট টর্চ নিয়ে এসেছিল তারা। ঘরের আলো জ্বালতে দেয়নি। জয়ন্তবাবুকে আলাদা ঘরে বসিয়ে রাখে। তিনি কান্নাকাটি করায় ‘ভয়ের কিছু নেই’ বলে অভয়ও দেয়। এমনকী সিগারেটও দেয় এক দুষ্কৃতী। রনিতাদেবী বলেন, “সব ঘরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশেষ কিছু না পেয়ে আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ওরা। তখনই বাইরে থেকে সঙ্গীদের সঙ্কেত পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়।”
দুষ্কৃতীদের তিন নম্বর নিশানা ছিল শ্যামাপ্রসাদ নগরের কৃষ্ণেন্দু ও দিব্যেন্দু রাহার বাড়ি। ব্যাগের কারিগর কৃষ্ণেন্দুবাবুর ভাই দিব্যেন্দুবাবু মিনিবাসের কন্ডাক্টর। ভোর তিনটে নাগাদ রাহা বাড়ির গ্রিলের তালা ভেঙে ঢোকে দুষ্কৃতীরা। কিছুক্ষণ আগেই অভ্যাসমতো বারান্দায় রাখা ব্যাগ তৈরির যন্ত্রপাতি দেখতে উঠেছিলেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। তার পরে দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়েন। ঘরে ঢুকতে তাই বেগ পেতে হয়নি ডাকাতদের। দিব্যেন্দুবাবুর স্ত্রী রাখিদেবী বলেন, “আমার মাথায় আর গলায় হাত বোলাচ্ছিল এক ডাকাত। চোখ মেলে মুখবাঁধা অনেক লোককে ঘরে দেখে চমকে উঠি। ভয়ে আমার ছেলে কেঁদে উঠতেই এক ডাকাত আগ্নেয়াস্ত্র গলায় ঠেকিয়ে বলল, ‘ওর কান্না থামা, নয়তো খুন করে দেব।’ এই ঘরে গাঁজা রাখা এবং লুকিয়ে থাকা কাউকে খোঁজার ভান করে সব ছড়িয়ে ফেলতে লাগল ওরা। বাধ্য হয়েই টাকা, গয়না সব দিই। মোবাইলও নিয়ে নিল।” রাখিদেবীরা জানান, এখানেও বাড়ির দু’জন পুরুষকে একটি ঘরে মাথায় চাদর চাপা দিয়ে বসিয়ে রাখে দুষ্কৃতীরা। যাওয়ার আগে মারধরও করে। জিনিসপত্র কয়েকটি বাজারের থলেতে ভরে সাদা গাড়িতে চেপে চলে যায়।
রবিবার রাতের মতো ঘটনা এখন নিমতায় নতুন কিছু নয়। আতঙ্কিত বাসিন্দারা আঙুল তুলছেন পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার দিকেই। অভিযোগ, গত তিন মাসে এলাকায় একই ধরনের ছ’টি ঘটনা ঘটলেও পুলিশ কোনওটিরই কিনারা করতে পারেনি। অন্য দিকে, পুলিশের এক শ্রেণির অফিসারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই দেদার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় কংগ্রেস নেতা শক্তি মৈত্র বলেন, “ব্যারাকপুর কমিশনারেটে শুধু নিমতা ও ঘোলার জন্য এক জন ডিএসপি আছেন। আমরা প্রশাসনের কাছে নিমতায় পরপর ডাকাতি নিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। আধিকারিকেরা শুধু আশ্বাস দিয়েছেন। কোনও কাজ যে হয়নি, এই ঘটনা ফের তা প্রমাণ করল। রবিবার রাতের তিনটে ডাকাতিই হয়েছে নিমতা তদন্তকেন্দ্রের কাছে।”
পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় সিংহ বলেন, “টহলদারি বাড়ানো হয়েছে। ঘটনার সময়েও টহলদারি ছিল। বড় এলাকা, তাই কোথায় কী হচ্ছে, সব সময় হয়তো সঙ্গে সঙ্গে খবর পাওয়া যায় না। তবে আমরা তদন্ত শুরু করেছি।” রবিবার রাতের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.