প্রস্তাব স্বাস্থ্য দফতরকে
রক্ত-খরা রুখতে হোক দানের ক্যালেন্ডার
ক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, চোদ্দো বছরের অয়নের অনুচক্রিকা (প্লেটলেট) নেমে যাচ্ছে হু হু করে। দু’দিনের মধ্যে তা প্রায় পঞ্চাশ হাজারে ঠেকেছে। ডাক্তারেরা বলছেন, ডেঙ্গি-আক্রান্ত কিশোরটির জন্য অবিলম্বে রক্তের ওই উপাদানটি দরকার। কিন্তু সরকারি ব্ল্যাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেট নেই!
উল্টোডাঙাবাসী বছর বাহান্নর আলোলিকা দাশগুপ্তের ছেলেরাও একই সমস্যায় পড়েছেন। ডেঙ্গি সংক্রমণের ফলে প্রৌঢ়ার অনুচক্রিকা ১ লক্ষ ৪০ হাজার থেকে এক রাতে নেমে গিয়েছে ৬০ হাজারে! ডাক্তার প্লেটলেট মজুত রাখতে বলেছেন। ছেলেরা সরকারি সব ব্লাড ব্যাঙ্ক চষে ফেলেও খালি হাতে ফিরেছেন।
শেষমেশ অবশ্য অয়নের জন্য অনুচক্রিকা মিলেছে। আলোলিকাদেবীর সঙ্কটও কেটেছে। তবে দু’টো পরিবারকেই তা জোগাড় করতে হয়েছে বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে। চড়া দামে।
অয়ন-আলোলিকার ঘটনা ডেঙ্গি-কবলিত কলকাতা-সল্টলেকের সাধারণ মানুষের ভোগান্তির দু’টো উদাহরণ মাত্র। মশাবাহিত ওই রোগের দাপটে অনেকের ‘প্লেটলেট কাউন্ট’ ২০ হাজারেও নেমে যাচ্ছে (যা থাকা উচিত দু’থেকে আড়াই লক্ষ)। কারও হিমোগ্লোবিন নেমে যাচ্ছে ৪-৫ গ্রামে (যার স্বাভাবিক পরিমাপ ১০০ মিলিলিটারে ১২-১৭ গ্রাম)। ওঁদের বাঁচাতে অনুচক্রিকা বা রক্ত ছাড়া গতি নেই।
কিন্তু সেই প্রাণদায়ী জিনিসটি জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে পরিজনের।
অথচ সারা বছর তো বিভিন্ন সংস্থা, ক্লাব ও রাজনৈতিক সংগঠন রক্তদান শিবির করে! কোথাও চল্লিশ, কোথাও পঞ্চাশ, কোথাও বা আশি-একশো জনও রক্ত দেন। এত শিবির সত্ত্বেও সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোর এমন দুর্দশা কেন? দানের রক্ত যায় কোথায়?
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের ব্যাখ্যা: রক্তদান শিবির আয়োজনের কোনও সুসংহত সময়সূচি না-থাকাতেই এই অবস্থা। যেমন কলকাতায় যে গোটা কুড়ি সংস্থা বা ক্লাব ফি বছর শিবিরের আয়োজন করে, তাদের অধিকাংশের লক্ষ্য থাকে ১২ জানুয়ারি (বিবেকানন্দের জন্মদিন), ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগস্ট, ১ মে, ১৬ অগস্ট (ফুটবলপ্রেমী দিবস) বা ২ অক্টোবরের মতো ‘বিশেষ’ কিছু দিন। নিদেনপক্ষে রবিবার। ফলে সপ্তাহের অন্য দিনগুলো ফাঁকা যায়। আবার ওই ‘বিশেষ বিশেষ’ দিনে এত বাড়তি রক্ত সংগ্রহ হয় যে, সংরক্ষণ-ক্ষমতার অভাবে কিছু রক্ত নষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে পরীক্ষার মাসে, উৎসবের মরসুমে কিংবা চড়া গরমের সময়ে রক্তের অভাবে মানুষকে নাজেহাল হতে হয়। কারণ, তখন বলে-কয়েও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা ক্লাবগুলোকে দিয়ে শিবির করানো যায় না বলে স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনুযোগ।
বছরভর রক্তের জোগান ঠিক রাখার উপায় তা হলে কী?
সঙ্কটের মোকাবিলায় চিকিৎসক ও রক্তদান আন্দোলনে জড়িতদের একাংশ স্বাস্থ্য দফতরকে প্রস্তাব দিয়েছেন, রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদ এ বার বছরওয়াড়ি ‘রক্তদান ক্যালেন্ডার’ তৈরি করুক, যাতে রক্তদান শিবির বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটা মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিনে আটকে না-থাকে। ক্যাম্পগুলোকে বছরের প্রতিটা মাসে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়া যায়। ডাক্তারদের বক্তব্য: এতে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে রক্তের আকাল অনেকটা মেটানো যাবে। অন্য দিকে রক্ত উদ্বৃত্তও হবে না। পাশাপাশি একই দিনে একাধিক সংগঠনের রক্তদান শিবির হলে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসক-কর্মীরা অনেক শিবিরে যেতে পারেন না। ‘ক্যালেন্ডার’ থাকলে এর সুরাহা তো হবেই, উপরন্তু বাড়তি শিবির করে রক্তের জোগান বাড়ানো সম্ভব হবে বলে এই মহলের দাবি। প্রস্তাবকারীদের অন্যতম, চিকিৎসক অমিতাভ নন্দীর কথায়, “এ বার ডেঙ্গির চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছি, মানুষ প্লেটলেটের জন্য কেমন অসহায় ভাবে ছোটাছুটি করেছেন। আমার ধারণা, বছরভর সমান হারে রক্তদান শিবির হলে সব সময়ে রক্তের পর্যাপ্ত জোগান থাকবে। দরকারের মুহূর্তে হাহাকার পড়বে না। ”
প্রস্তাবটি সম্পর্কে স্বাস্থ্য-প্রশাসনের কী বক্তব্য?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তরফে রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়টি দেখভাল করে যারা, সেই রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (স্যাক্স)-র প্রকল্প-অধিকর্তা রেশমি কমালের প্রতিক্রিয়া, “ভাবনাটা সত্যিই ভাল। আমরা ব্লাড ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্ট নিয়ে নতুন করে চিন্তা করছি। এই ক্যালেন্ডার তৈরির প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা করা হবে।” উল্লেখ্য, রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদও স্যাক্সের অধীনে কাজ করে।
কিন্তু এ ধরনের ক্যালেন্ডার করা হলে ‘হিতে বিপরীত’ হওয়ার আশঙ্কাও দানা বাঁধছে অনেকের মধ্যে। কী রকম?
স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের মতে, এখানে বেশ কিছু রক্তদান শিবিরের আয়োজন হয় নিছক ‘হুজুগে’র জেরে। সেখানে আগাম দিন বেঁধে দিলে রক্তদাতাদের অনেকে উৎসাহ হারাতে পারেন। এবং সে ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা আদৌ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে শিবির করবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। রক্তদান আন্দোলনে জড়িত এক সংগঠনের কর্তা ডি আশিস যেমন বলছেন, “ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের মূল আয়োজক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ক্যালেন্ডার করে এদের দিয়ে অন্য দিনে শিবির করানো কঠিন।” রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্রের মন্তব্য, “রবিবার এবং বিশেষ ছুটির দিনে রাজনৈতিক নেতাদের পাওয়া যায়। আর বাস্তব ঘটনা হল, নেতাদের উপস্থিতি ছাড়া দলগুলো ক্যাম্প করতে চায় না।”
তাই ‘ক্যালেন্ডার’ বানিয়ে সপ্তাহের কাজের দিনে শিবির আয়োজনে ‘বাধ্য করলে’ উদ্যোক্তারা বেঁকে বসতে পারে বলে দীপঙ্করবাবুদের আশঙ্কা। ‘ক্যালেন্ডারের’ পক্ষপাতী যাঁরা, তাঁরা অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন। এঁদের দাবি, মানুষের মধ্যে প্রচার যত বেশি হবে, তত এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে। “আগে মানুষ রক্ত দিতেই ভয় পেতেন। প্রচারের জোরে তা অনেকাংশে কাটানো গিয়েছে। একই ভাবে রক্তদানের ক্যালেন্ডার বানাতেও অসুবিধে হবে না।” বলেন শহরের এক চিকিৎসক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.