হানাদার শনাক্ত, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন নম্বর
হামলাকারীকে শেষমেশ চেনা গেল। এ বার শহর কাঁপাতে এসেছে ডেঙ্গির ‘তিন নম্বর’ ভাইরাস।
কলকাতা-সল্টলেক দাপিয়ে বেড়ানো ডেঙ্গি-ভাইরাসটি ঠিক কী গোত্রের, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা রীতিমতো ধাঁধায় ছিলেন। ঠিক ধরতে পারছিলেন না, কেন এ বার ডেঙ্গির তীব্রতা এত বেশি। অবশেষে বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর গবেষকেরা দিশা দিয়েছেন। আক্রান্তদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে তাঁদের দাবি, হানাদার ভাইরাসটি মূলত ‘ডেং-থ্রি’ প্রজাতির।
নাইসেডের অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তী বলেন, “২০০৮-’০৯ সালে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে যে ডেঙ্গি হানা দিয়েছিল, তার মূলে ছিল ডেঙ্গি ভাইরাসের তিনটি প্রজাতি। ডেং-১, ২ ও ৪। তাদের বিরুদ্ধে কলকাতা ও আশপাশের মানুষের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা।” তাই এ বারের সংক্রমণের তীব্রতা দেখে চিন্তায় পড়েছিলেন শেখরবাবুরা। এখন জানা গেল, এ বছর চড়াও হওয়া ডেঙ্গি ভাইরাসটি হল ডেং-৩, যার সামনে এখানকার মানুষের শরীর প্রতিরোধহীন।
আর এতেই বিভ্রান্তি কেটেছে। বোঝা গিয়েছে, মানবশরীর কেন এই জীবাণুকে ‘চিনতে’ পারছে না। শেখরবাবুর ব্যাখ্যা, “আমরা অন্তত পঞ্চাশটি নমুনা পরীক্ষা করে মোটামুটি নিশ্চিত যে, এ বার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে ডেং-থ্রি প্রজাতির ভাইরাস। তার বিরুদ্ধে এখানকার মানুষের শরীরে এখনও অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ-ব্যবস্থা তৈরি হয়নি।” কিছু নমুনায় অবশ্য ডেং-১ ভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে বলে জানিয়েছেন শেখরবাবু। তবে তার সংক্রমণের তীব্রতা তুলনায় অনেক কম।
এক-দুই-চারের তুলনায় তিন নম্বর ডেঙ্গি কি বেশি শক্তিশালী?
শেখরবাবুর জবাব, “তেমন কিছু জানা নেই। আমাদের প্রাথমিক ধারণা, জীবাণুটি শরীরের কাছে অপরিচিত বলেই এত বাড়াবাড়ি।” উল্লেখ্য, ২০০৫-এ পশ্চিমবঙ্গে যে ডেঙ্গি-ভাইরাস চড়াও হয়, সেটাও ছিল ডেং-৩। সে বারও সংক্রমণের তীব্রতা ছিল অনেকটা এ বারের মতো। “২০০৫-এ পুণের ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি’তে কলকাতায় আক্রান্ত বেশ কিছু মানুষের রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছিল।

শিয়রে সংক্রমণ
রোগ জীবাণু বাহক
ডেঙ্গি ডেঙ্গি ভাইরাস এডিস ইজিপ্টাই (মশা)
চিকুনগুনিয়া আলফা ভাইরাস এডিস ইজিপ্টাই (মশা)
ম্যালেরিয়া প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স পরজীবী
প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম পরজীবী
অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই (মশা)
চিকেন পক্স হারপিস জস্টার ভাইরাস বাতাস
টাইফয়েড স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাক্টেরিয়া খাবার বা জল
পুণে তখন জানিয়ে দেয়, ডেং-থ্রি’র সংক্রমণ হয়েছে। ওটা কিন্তু ২০০৮-’০৯ সালে আসেনি। ঘুরে এল ২০১২-য়।” বলেন শেখরবাবু।
তা হলে ডেং-৩ ‘অপরিচিত’ কেন? ২০০৫-এর হামলার জেরে দেহে তো তিন নম্বরের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধক্ষমতা মজুত থাকার কথা!
হুগলি মহসিন কলেজের শারীরবিদ্যার শিক্ষক কৃষ্ণা রায় জানাচ্ছেন, রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, কাজ না-পেলে তা ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ২০০৫-এর সেই সংক্রমণের পরে সাত বছর কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে ডেং-৩ আসেনি। কাজেই তার বিরুদ্ধে শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ-ব্যবস্থা ক্রমে কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে নতুন করে হানা দেওয়া ‘তিন নম্বর’ ভাইরাস শরীরের কাছে ‘অচেনা’ই। এরই মওকায় সে এত মারমুখী হয়ে উঠতে পেরেছে।
শুধু ডেঙ্গি নয়। নানা জীবাণুর সম্মিলিত হামলায় পুজোর মুখে শহরবাসী বিপর্যস্ত। ডেঙ্গির পাশাপাশি হানা দিয়েছে চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, এমনকী জলবসন্তও (চিকেন পক্স)! যেমন সল্টলেকের এক আবাসনে দু’ভাইয়ের ডেঙ্গি-জলবসন্তের ‘ক্রস ইনফেকশন’ হয়েছে। প্রথমে বড়র ডেঙ্গি হয়েছিল, ছোটর চিকেন পক্স। ছোট ভাই চিকেন পক্স থেকে সেরে উঠে এখন ডেঙ্গিতে কাবু। আর বড় ভাই ডেঙ্গি হামলা সামলানোর পরে চিকেন পক্সে আক্রান্ত। বড়বাজারে আবার এক জনের ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া-চিকুনগুনিয়ার ‘ত্রিফলা’ সংক্রমণ হয়েছে। বেহালায় এক জনের রক্তে মিলেছে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গির জীবাণু। শহরে টাইফয়েড, ম্যালেরিয়াও ছড়াচ্ছে।
এবং এক সঙ্গে এত রোগের সংক্রমণের জন্য পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা অনেকাংশে আঙুল তুলছেন পরিবেশের দিকে। শেখরবাবু যেমন বলেছেন, “বর্ষা পিছিয়ে এসেছে। তার একটা প্রভাব তামাম জীবজগতে পড়তে বাধ্য। বিশেষত এককোষী জীবাণুরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খুব তাড়াতাড়ি খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তাদের জিনগত পরিবর্তন দ্রুত হয়। এটা একমাত্র কারণ না-হলেও অন্যতম কারণ হতে পারে।”
কিন্তু বছরের এই সময়টায় চিকেন পক্স হওয়াটা কি স্বাভাবিক?
নাইসেড-অধিকর্তার ব্যাখ্যা, “চিকেন পক্সের পিছনে রয়েছে হারপিস জস্টর নামে এক ভাইরাস। তা শরীরে ঢুকে স্নায়ুর প্রান্তভাগকে প্রভাবিত করলে হারপিস হয়। অন্য প্রতিক্রিয়াটি চিকেন পক্স।” শেখরবাবু জানিয়েছেন, এই ভাইরাস সংক্রমণের নির্দিষ্ট সময় নেই, তা বছরভর সক্রিয় থাকে। টাইফয়েডের জীবাণুও তা-ই।
এ সবেরও বাড়তি হিসেবে শহরবাসীকে ভোগাচ্ছে অজ্ঞাতপরিচয় এক রোগ, যার উপসর্গ ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়ার মতো। ১৫-২০ দিন জ্বর থাকছে, প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ছে রোগী। অথচ রক্ত পরীক্ষায় কোনও জীবাণু ধরা পড়ছে না। যদিও অণুচক্রিকা বা প্লেটলেটের সংখ্যা না-কমায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার পড়ছে না। প্যারাসিটামলেই ধীরে ধীরে উপশম হচ্ছে।
গত বছরও এমন ‘অজানা’ জ্বর মহানগরে হানা দিয়েছিল। পুণেও তার জীবাণু শনাক্ত করতে পারেনি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.