পাকিস্তান যে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হইয়া উঠিতে ব্যর্থ, তাহার অন্যতম প্রমাণ মৌলবাদী শক্তিকে আইনের শাসনের অধীন করিতে পাক সরকারের ব্যর্থতা। পয়গম্বরকে কলঙ্কিত করিয়া নির্মিত একটি চলচ্চিত্রের প্রতিবাদে সমগ্র ইসলামি দুনিয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানেও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হইতেছে। কিন্তু পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে এই বিক্ষোভ উপলক্ষে বিভিন্ন শহরে দুষ্কৃতীরা দোকান, ব্যাংক, এটিএম লুঠপাট করিয়াছে, সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করিয়াছে, সিনেমা হলে আগুন লাগাইয়াছে এবং এক দিনেই অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু ঘটাইয়াছে। দুষ্কৃতীদের এই তাণ্ডব দেশ জুড়িয়া সংঘটিত হইলেও পাক সরকার তাহা মোকাবিলায় সফল হয় নাই, সে ভাবে সচেষ্টও না। কারণ মৌলবাদীরা বহু কাল হইতেই পাক সরকার, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীকে তাঁবেদারে পরিণত করিয়াছে।
সরকার ভাবিয়াছিল, বিক্ষোভের বাষ্প বাহির হইয়া গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হইবে। তাই সরকারের তরফেই জুম্মাবারের দিনটিকে ‘পয়গম্বরকে ভালবাসার দিন’ রূপে পালন করার ডাক দেয়। দেখা গেল, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনরক্ষকদের ঠুঁটো করিয়া দুষ্কৃতীরা ইসলামের অবমাননার ‘প্রতিকার’ করিতে তাণ্ডবে মাতিল। পাক সরকার এই উপলক্ষে আপন প্রশাসনিক দায় ও নৈতিকতা সম্পূর্ণ খোয়াইয়া বসিয়াছে। অনুরূপ ঘটনা প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের জমানায় লাল মসজিদ কাণ্ডের সময়েও ঘটিয়াছিল। একই ভাবে সে দিনও সশস্ত্র মৌলবাদী ও দুষ্কৃতীরা পাক নিরাপত্তা বাহিনীর সহিত প্রকাশ্য সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হইয়াছিল। বিগত বেশ কিছু কাল যাবৎ পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সেনাঘাঁটি, বিমানঘাঁটি, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র তালিবান ও অন্যান্য জেহাদি জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হইতেছে। যে ভাবে প্রহরা এড়াইয়া বা প্রহরাবেষ্টনী চূর্ণ করিয়া লস্কর-এ-তইবা কিংবা হাক্কানি গোষ্ঠীর জেহাদিরা পাক সামরিক ও অসামরিক কর্তৃপক্ষের ঘাঁটিগুলি ঝটিকা-হানায় বিপর্যস্ত করিতেছে, তাহাতে সরকারের অস্তিত্ব লইয়াই সংশয় সৃষ্টি হয়। বর্তমান উদাহরণটিতে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সরকারের নরম মনোভাব দেখিলে সরকারের সদিচ্ছা বিষয়ে প্রশ্ন জাগে বইকী।
মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন সার্বভৌমত্ব বিষয়ে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর সফররত পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন, সার্বভৌমত্ব কেবল ভৌগোলিক সীমান্তের অনাক্রম্যতা নয়, ইহার সহিত দেশবাসীর মানবাধিকার সুরক্ষিত করা, নিজের ভূখণ্ডকে রাষ্ট্রবিরোধীদের হাতে তুলিয়া না-দেওয়া, প্রতিবেশীদের নিরাপত্তা বিপন্ন না-করা, আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না-করার দায়বদ্ধতাও যুক্ত। এই সব কটি প্রশ্নেই পাকিস্তানের সরকার কোনও দায়বোধের পরিচয় দেয় নাই। বরং, পাক সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচুর ভারত ও আফগানিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্নকারী লস্কর-এ-তইবা ও হাক্কানি গোষ্ঠীকে পুষিয়া চলিয়াছে, বিন লাদেনকে ছয় বৎসর নিরাপদ আশ্রয় দিয়াছে, জেহাদি তালিবানদের অস্ত্র ও রসদসজ্জিত করিয়াছে। সার্বভৌমত্বের অভিমান অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব বিনাশকারী শক্তিদের আশ্রয়দাতাকে মানায় না। পাকিস্তান যদি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ কিংবা ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এর অমর্যাদায় ভূষিত হইতে না চায়, তবে মৌলবাদীদের সহিত তাহাকে সংগ্রামে নামিতে হইবে। সমস্যা হইল, জেনারেল জিয়া-উল-হকের কাল হইতে পাক সমাজ মৌলবাদী আফিমে আচ্ছন্ন। সেই ঘোর কাটাইয়া উঠিবার সদিচ্ছা রাজনীতিকদের আছে কি? হাতে কিন্তু আর সময় নাই। |