আর সংশয় নাই। মনমোহন সিংহের ঘুম নিশ্চিত ভাঙিয়াছে। তিনি সংস্কারের কর্মসূচি ঘোষণা করিয়াই থামেন নাই। তিনি যে সেই পথ ছাড়িবেন না, তাহা ফের জানাইয়াছেন। কেন সেই পথে থাকা প্রয়োজন, টেলিভিশনে বক্তৃতা করিয়া দেশবাসীকে বুঝাইয়াও বলিয়াছেন। দীর্ঘ ঘুমের পর তাঁহার এই আকস্মিক আক্রমণাত্মক মূর্তি দেখিয়া কূম্ভকর্ণের কথা মনে পড়া বোধ হয় দোষণীয় নহে। ঘুম ভাঙা ভাল। তবে দুর্জনে প্রশ্ন করিতে পারে, এত বিলম্ব হইল যে? দ্বিতীয় প্রজন্মের আর্থিক সংস্কার ব্যতীত এই দেশের যে গতি নাই, এই কথাটি তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক বলিতেছেন। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি বা খুচরা বিপণনে বিদেশি পুঁজিকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত করিবার চেষ্টাও করিয়াছেন। কিন্তু সকলই সম্ভবত ঘুমের ঘোরে। ফলে, প্রতি বারই এক পা অগ্রসর হওয়ার পর দুই পা পিছাইয়া আসাই নিয়ম ছিল। এই বার ব্যতিক্রম হইল। এত দিন না হওয়া আর এই বার হওয়ার মধ্যে সম্পর্কটি অতি স্পষ্ট। এত দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণের উত্তর সন্ধানে ব্যস্ত থাকায় প্রধানমন্ত্রী সংস্কারে আন্তরিক হওয়ার অবসর পান নাই। তাঁহার দল, দল হিসাবে, সংস্কারে তেমন বিশ্বাসী নহে। ফলে, সংস্কার লইয়া দলেরও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। তাঁহারা দুর্নীতির অভিযোগ ঠেকাইবার পর যে সময়টুকু পাইয়াছিলেন, তাহাতে শরিক-তোষণে ব্যস্ত ছিলেন। রাজনীতির সমীকরণের দায় অর্থনীতি বুঝে না। ফলে, কংগ্রেস যখন বিবিধ সমীকরণ মিলাইতে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে ভারতীয় অর্থনীতি বেহাল হইয়াছে। শেষ বেলায় এই তুমুল সংস্কার, অতএব, যতখানি মনমোহন সিংহের কৃতিত্ব, তাহা অপেক্ষা বেশি বাধ্যবাধকতা। অবশ্য, দায়ে পড়িয়া হইলেও, কাজগুলি যথার্থ হইয়াছে। বহু পূর্বেই ভারতের এই পথে হাঁটা উচিত ছিল। সৌভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী আরও বিলম্ব করেন নাই।
প্রধানমন্ত্রীর এই আগ্রাসী সংস্কারেচ্ছা অপেক্ষাও যদি বিরলতর কিছু থাকে, তবে তাহা প্রধানমন্ত্রীর বাক্স্পৃৃহা। সংসদে বাদল অধিবেশনের সমাপ্তিলগ্নে তিনি নিজের হতাশার কথা বলিয়াছিলেন। তাহার পর পক্ষকাল কাটে নাই, সংস্কার প্রসঙ্গে জাতির উদ্দেশে স্বতঃপ্রণোদিত ভাষণ দিলেন তিনি। দেশবাসীকে বুঝাইয়া বলিলেন, কেন এই মুহূর্তে সংস্কারই একমাত্র পথ। তিক্ত হইলেও ইহাই ঔষধ। দেশবাসী বুঝিবে কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন, কিন্তু মৌন থাকিবার কুফল প্রধানমন্ত্রী বড় বিলম্বে বুঝিলেন। গত তিন বৎসরে যে তাঁহার সরকার এক সংকট হইতে অন্য সংকটে পড়িয়াছে, তাহার একটি বড় কারণ, প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন নাই। ইউ পি এ-র প্রধান শরিক হিসাবে কংগ্রেস কী ভাবিতেছে, সরকারের শীর্ষকর্তা রূপে প্রধানমন্ত্রীই বা কী ভাবিতেছেন, তাহা প্রকাশ করিবার দায়িত্ব তাঁহারই ছিল। জমি অধিগ্রহণ বিল লইয়া কংগ্রেসি মন্ত্রীদের আপত্তি প্রমাণ করিয়াছেন, দলের মধ্যেও কথা বলিবার রেওয়াজ নাই ‘বাহিরের লোক’-এর সহিত কথা বলিবার প্রশ্নই উঠে না। ফলে প্রধানমন্ত্রী শরিকদের সহিত কথা বলেন নাই, বিরোধীদের আলোচনার পরিসরে আনিবার চেষ্টা করেন নাই। আর, সাধারণ মানুষ সম্ভবত ধরিয়া লইয়াছেন যে নয়াদিল্লির ক্ষমতার চূড়া তাঁহাদের বাক্যালাপের যোগ্য বোধ করে না। ফলে, একবিংশ শতাব্দীতে যখন দুনিয়াব্যাপী যোগাযোগের বিস্ফোরণ ঘটিতেছে, কংগ্রেস তখন সম্পূর্ণ যোগাযোগহীন একটি দলে পর্যবসিত হইয়াছে। কংগ্রেস কী চায়, কেন চায়, তাহাতে কাহার লাভ, কাহার ক্ষতি এই কথাগুলি যদি সকল পক্ষ সমান ভাবে জানিত, তবে সেই চাওয়ার পথটি সুগম হইত। হয়তো আজ সংস্কারের জন্য এমন মরিয়া হইতে হইত না, সংস্কার নিজের গতিতেই চলিত। সেই যখন মুখ খুলিলেনই, আর কয়টা দিন পূর্বে খুলিলেই বেশ হইত। দেওয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত স্থিতিজাড্য কাটাইতে না পারিবার অভ্যাসটি প্রাণঘাতী। |