ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই এক মাত্র রাজ্য, যেখানে শাসক এবং বিরোধী দল দু’পক্ষই এই মুহূর্তে মনমোহন সিংহের সরকারের বিরোধী! মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র বিরোধিতা অবশ্য নতুন নয়। ‘বাগী’ মমতার কোপের মুখে বারবার পড়েছে দিল্লি। নরসিংহ রাও থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ী, আজ মনমোহন সিংহ এই বঙ্গললনার বিদ্রোহের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ।
রাজীব গাঁধী তখন প্রধানমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের নবীনতম সাংসদ মমতাকে খুবই স্নেহ করতেন দেশের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ কল-কারখানা খোলার দাবিতে সাতসকালে কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী ভেঙ্গল রাওয়ের দফতরের সামনে ধরনায় বসে সেই রাজীবকেই যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছিলেন মমতা।
সিপিএমের বিরুদ্ধে দিল্লি যথেষ্ট সক্রিয় নয়, এই অভিযোগে তুলে ‘বিদ্রোহ’ করেছিলেন নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভার ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মমতা। ধর্মতলায় ধরনাতেও বসেছিলেন সিপিএমের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আইন ভাঙছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই মর্মে নালিশ করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
মমতার সেই ধরনা তুলতে সক্রিয় হতে হয়েছিল নরসিংহ রাওকে। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বসে মমতাকে ধরনা থেকে তোলার জন্য রাস্তা খুঁজতে নেমেছিলেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি একটা খসড়া তৈরি করেন, তাতে বলা হয়, মমতা ধরনা তুলে নিলে কেন্দ্র যথোচিত ব্যবস্থা নেবে। খসড়াটি চূড়ান্ত করে প্রণববাবু চলে যান বিদেশে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভুবনেশ চতুর্বেদী সেটি ফ্যাক্স করে পাঠান মমতাকে। ফ্যাক্সের ভাষা দেখে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন মমতা। ধরনা না তুলে উল্টে ব্রিগেডে সমাবেশ ডেকে সিপিএমের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজান এবং দিল্লি ‘সিপিএম-বিরোধী’ হচ্ছে না, এই অভিযোগ তুলে জনসভায় দাঁড়িয়েই মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন! পর দিন সকালে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব অশোক সুব্রহ্মণ্যমকে দিয়ে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীকে।
‘বিদ্রোহী’ মমতাকে দিল্লি বারাবার দেখেছে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানাতেও। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-সরকারে মমতা তখন রেলমন্ত্রী। দিল্লির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র যথেষ্ট টাকা দিচ্ছে না। বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা প্রমোদ মহাজন এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতের যুগ্মসচিব সুধীন্দ্র কুলকার্নি মিলে পশ্চিমবঙ্গকে কী ভাবে টাকা দেওয়া যায়, বিভিন্ন মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলে তার একটি প্যাকেজও তৈরি করেন। ব্রিগেডের জনসভায় প্রমোদ মহাজন হাজির থেকে সেই প্যাকেজ ঘোষণাও করেন। কখনও সন্ত্রাস দমন আইন টাডা-র, কখনও সন্ত্রাস দমন আইন পোটা-র বিরোধিতায় সরব হয়েছেন তিনি।
আবার লোকসভার ডেপুটি স্পিকার পদে বিজেপি-র প্রার্থী রীতা সিংহকে সমর্থন না করে কংগ্রেস প্রার্থী পি এম সঈদকে সমর্থন করে জোটসঙ্গী বিজেপিকে বিপদে ফেলেছিলেন মমতা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাজপেয়ী সরকারের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কেলেঙ্কারির প্রতিবাদ জানিয়ে বিজেপির উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিলেন ২০০১ সালে। কালীঘাটের বাড়িতে এসেও মমতাকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। পরে অবশ্য বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় ফিরেছিলেন মমতা।
মনমোহন সিংহ কালীঘাটের বাড়িতে এখনও পর্যন্ত আসেননি। কিন্তু তিনি মমতাকে দেখছেন অনেক দিন থেকে। মনমোহন সিংহ তথা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন মমতা সম্পর্কে একটা কথাই বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ‘টাফ্ বারগেনার’। তবে এ বার এই দর কষাকষির রাজনীতিতে কিছুতেই আপস করতে রাজি হননি মনমোহন। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মননে সম্ভবত দিল্লি-বিরোধী বামপন্থী রোম্যান্টিক বিদ্রোহের একটা পরিসর আছে। সেই পরিসর দখল করে চৌত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। সুভাষ বসুর ‘দিল্লি চলো’ হুঙ্কারের সেই বামপন্থী ডিএনএ অনুসরণ করে এখন মমতা ক্ষমতায়। ক্ষমতায় বসেও মমতা কিন্তু সেই পরিসরটি অন্য কাউকে দিতে নারাজ।
আর তাই গোটা দেশে পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য, যেখানে যাবতীয় মেরুকরণ উড়িয়ে শাসক-বিরোধী দু ’পক্ষই এখন কেন্দ্র বিরোধী। |