প্রাণপণে ভ্যানরিকশা চালিয়েও বাবাকে বাঁচাতে পারেননি সন্দেশখালির সেহেরা গ্রামের মোক্তার সর্দার। হাসপাতালে পৌঁছতে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, দেরি হয়ে গিয়েছে। আর কিছু করার নেই। তীব্র যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠেছিল।
একই যন্ত্রণা রায়পুর গ্রামের হরিশচন্দ্র দাসেরও। পৌঁছতে দেরি হওয়ায় তিনিও হারিয়েছিলেন স্ত্রীকে।
সুন্দরবনের সন্দেশখালি ১ ব্লকের এই দ্বীপভূমিতে এমন ছবি অতি পরিচিত। অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা যান বহু রোগী। এই ছবি পাল্টে দিতে শপথ নিয়েছিলেন মোক্তার-হরিশচন্দ্রেরা। তাঁরা কালীনগর, সেহেরা-রাধানগরের কয়েক জন ভ্যানরিকশা চালক। গত চার বছর ধরে নিজেরা একটু একটু করে টাকা জমিয়ে কিনে ফেলেছেন একটি পুরনো মারুতিভ্যান। সেটিকেই সারিয়ে এলাকার মানুষের জন্য নতুন অ্যাম্বুল্যান্স গড়ে তুলেছেন তাঁরা। যার পরিষেবা খরচও যৎসামান্য, ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। গত মঙ্গলবার সন্দেশখালি ১-এর বিডিও উদ্বোধন করলেন সেই অ্যাম্বুল্যান্স।
কালীনগর, সেহেরা-রাধানগর এই দুই পঞ্চায়েত এলাকা আদতে দ্বীপভূমি। বেতনী ও ডাঁসা নদী ঘিরে রেখেছে তাদের। সব থেকে কাছের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ৯-১০ কিমি দূরে ঘোষপুরে। সেখানে অ্যাম্বুল্যান্স মাত্র একটি। সেটিও মাতৃযান, নির্ধারিত শুধু প্রসূতিদের জন্য। এলাকার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কোনও অ্যাম্বুল্যান্স নেই। ফলে অসুস্থদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভরসা শুধু সাধারণ বা যন্ত্রচালিত ভ্যানরিকশা। কিন্তু ২০০৮-এর আয়লায় সুন্দরবনের এই সব প্রত্যন্ত এলাকার রাস্তাঘাট প্রায় মুছে যাওয়ায় সেটাও দুর্বিষহ পড়ে। |
এই পরিস্থিতিতেই স্থানীয় রিকশাচালকদের সংগঠন (কালীনগর, সেহেরা-রাধানগর রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন) নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে একটি অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। মোক্তার সর্দার বললেন, “আর কেউ যাতে তাঁদের বাবা-মাকে না হারান তাই এই চেষ্টা।” সংগঠনের সম্পাদক সুব্রত নাথ বলেন, “চার বছরে সদস্যদের মাসিক চাঁদা ও বিশ্বকর্মা পুজোর চাঁদার টাকা বাঁচিয়ে মারুতিভ্যানের দাম ও মেরামতির খরচ জোগাড় করেছি। পাশাপাশি, এলাকার দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হয়েছে।” সংগঠনের পক্ষে অনল ভৌমিক জানালেন, এলাকায় একটি অ্যাম্বুল্যান্স ভীষণ দরকার ছিল। সেই কথা মাথায় রেখেই ২২৫ জন যন্ত্রচালিত ও ৬৫০ জন সাধারণ ভ্যানরিকশার চালক ধীরে ধীরে এই টাকা জমিয়েছেন। ২০টিরও বেশি গ্রামের হাজার চল্লিশেক মানুষ এতে উপকৃত হবেন বলে তাঁর দাবি। আর পাঁচটা অ্যাম্বুল্যান্সের মতো সাদা রং করানো হয়তো সম্ভব হয়নি এখনও, তবে এর চালককে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করেছেন মোক্তারারা। সুব্রতবাবুর কথায়, “স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্যে ফার্স্ট এড দেওয়া, অক্সিজেন মাস্ক পরানো, স্যালাইন দেওয়া শেখানো হয়েছে। এমনকী, খুব প্রয়োজন হলে যাতে ইঞ্জেকশনও দিতে পারেন, সেই প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।”
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঘোষপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার সৌমিক রায় বলেন, “এই রকম একটি দ্বীপভূমিতে পিছিয়ে পড়া গরিব মানুষের জন্য শ্রমজীবী মানুষদের এই উদ্যোগ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।” অ্যাম্বুল্যান্সের উদ্বোধনে এসে উচ্ছ্বসিত সন্দেশখালি ১ ব্লকের বিডিও অনিন্দ্য গৌতম। বললেন, “অভিভূত করার মতো ঘটনা। এমন মহৎ কাজের সাক্ষী হতে পেরে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।”
এলাকার রতন সাঁপুই, রত্না মণ্ডলরা বললেন, “বেহাল রাস্তায় ভ্যানরিকশায় চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে পথেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়তেন রোগীরা। এ ভাবেই অসহায়ের মতো কত বাবা-মা-স্ত্রী পরিজনদের হারিয়েছি আমরা।” এ ভাবে আর এক জনকেও আর হারাতে চান না তাঁরা। মেরুন রঙা পুরনো গাড়িটিকে ঘিরে এখন এক অন্য আবেগ তাঁদের চোখে। |