গ্রামাঞ্চলে কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য-রক্ষায় ন্যূনতম দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলির প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। কিন্তু প্রকল্প চালুর নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হয়ে আট মাস কাটতে চললেও কাজ শুরু হয়নি। প্রকল্পে ইতিমধ্যে এত দেরি হওয়া নিয়ে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য দফতর ও স্কুল শিক্ষা দফতরের কাজিয়া তুঙ্গে উঠেছে। দেরির জন্য পরস্পরের উপর দোষ চাপানো চলছে পুরোদমে।
স্বাস্থ্য দফতরের অভিযোগ, গ্রামের অধিকাংশ কিশোরী এখন স্কুলে যায়। অথচ অধিকাংশ স্কুলে এতদিন মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচালয়ই তৈরি করেনি স্কুল শিক্ষা দফতর। শৌচালয় না-থাকলে ছাত্রীটি ঋতুকালীন সময়ে কোথায় ন্যাপকিন বদল করবে? কোথায়-ই বা ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলবে? তাই ন্যাপকিন-প্রকল্প শুরু হতে দেরি হয়েছে। পাশাপাশি স্কুল শিক্ষা বিভাগের দাবি, সমস্যা বুঝে তারা দ্রুত কয়েক হাজার মেয়েদের শৌচালয় গড়ে দিয়েছিল। তার পর দেখা গেল উল্টো চিত্র। নিজেদের পরিকাঠামোগত প্রস্তুতি শেষ না-হওয়ায় মাসের পর মাস প্রকল্প চালুর দিনক্ষণ পিছিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য-রক্ষার বিষয়টি মাথায় উঠেছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতরের অফিসারেরাই জানাচ্ছেন, ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা কিশোরীদের স্বাস্থ্য-পরিষেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময় অপরিচ্ছন্নতা থেকে যৌনাঙ্গে সংক্রমণ হতে পারে, পরবর্তীকালে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে মা ও শিশু দু’জনের উপর। স্বাস্থ্য দফতরে ইউনিসেফের তরফে নিযুক্ত উপদেষ্টা শুভঙ্কর ভট্টাচার্যের কথায়, “গ্রামাঞ্চলে অর্থাভাব ও সচেতনতার অভাবে অনেক কিশোরীই ন্যাপকিনের বদলে অপরিষ্কার কাপড় নেয় এবং সেটাই বারবার ধুয়ে ব্যবহার করে। এতে মারাত্মক সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এর জন্যই ২০১০-এ জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের টাকায় রাজ্যের ৯টি জেলার তিনটি করে ব্লকে কিশোরীদের ন্যূনতম দামে স্যানিটরি ন্যাপকিন দেওয়ার প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।” প্রকল্পে ঠিক হয়, ১০-১৯ বছরের মেয়েদের প্রতি মাসে গ্রামের অণ্বেষা ক্লিনিক থেকে ৬ টাকায় এক প্যাকেট স্যানিটরি ন্যাপকিন দেওয়া হবে। ন্যাপকিন তৈরি করবে বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী।
কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজ্যে আপার প্রাইমারি ও হাইস্কুল স্তরে মেয়েদের স্কুল ও কো-এডুকেশন স্কুলের মাত্র ১৬ শতাংশ-তে মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচালয় থাকায় প্রকল্প রূপায়নে সমস্যা তৈরি হয়। তখন মূলত স্বাস্থ্য দফতরের চাপেই ২০১১-১২ সালে রাজ্যে মেয়েদের স্কুল ও কো-এডুকেশন স্কুল মিলিয়ে ২১৭৪৫টি স্কুলে মেয়েদের আলাদা শৌচালয় তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
‘ডিস্ট্রিক্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন’ (ডাইস)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, তার মধ্যে ১১৬১৫টি শৌচালয় তৈরি হয়ে গিয়েছে। ২০১২-১৩ সালে আরও ১১৯৪৮টি স্কুলে মেয়েদের শৌচালয় অনুমোদিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে ৮৭৪৮টি শৌচালয়ের। এর প্রত্যেকটিতে ন্যাপকিন ফেলার আলাদা যন্ত্র (ইনসিনেরেটর) থাকছে। কিন্তু এত আয়োজন সত্ত্বেও ২০১১-এর ডিসেম্বরের নির্ধারিত সময়ে ন্যাপকিন দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর।
ক্ষুব্ধ সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তারা এখন অভিযোগ করছেন, “নিজেরা প্রস্তুতি না-নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা আমাদের দোষারোপ করেছিলেন। আমাদের কাজের ফাঁক খুঁজছিলেন। এখন আমরা স্কুলে-স্কুলে কয়েক হাজার মেয়েদের শৌচালয় বানিয়েছি। এখন কেন ওরা মেয়েদের ন্যাপকিন দিতে পারছে না? আসলে ফাঁক স্বাস্থ্য দফতরের পরিকল্পনায়।” এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অফিসার জ্যোতির্ময় চাকী বলেন, “হ্যাঁ, আমরা সর্বশিক্ষাকে মেয়েদের শৌচালয় তৈরি করতে বলেছিলাম। ওদের কাজটা অনেক সহজ। তাই ওরা তাড়াতাড়ি করতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের ন্যাপকিন বানানোর জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী বাছতে হচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে, তাদের টাকা ঠিক করতে হচ্ছে, বানানোর সময় ন্যাপকিনের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে উন্নত প্রযুক্তি আনতে হচ্ছে। তাতে সময় লাগবেই।” তাঁর আরও বক্তব্য, “গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রক একটি সংস্থাকে ন্যাপকিন তৈরির দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। সেই সংস্থায় আমাদের আপত্তি ছিল। তা নিয়ে টানাপোড়েনেও অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।”
তা হলে কবে থেকে কম দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাবে গ্রামের কিশোরীরা? নির্দিষ্ট কোনও জবাব দিতে পারছেন না স্বাস্থ্য-কর্তারা। দুই দফতরের টানাপোড়েনে কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যরক্ষা প্রকল্প পড়ে আছে সেই বিশ বাঁও জলে। |