|
|
|
|
|
|
|
অ্যাক্সোলট্ল |
হুলিয়ো কোর্তাসার
আর্জেন্টিনা |
অ্যাক্সোলট্ল নামে প্রাণীটির বিষয়ে আমার এক সময়ে বড় আগ্রহ ছিল। মাছ-ঘরে গিয়ে ওদের নিথরতা, ওদের অলস, মন্থর চালচলনের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকতাম সেই সময়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই মুহূর্তে আমি নিজে এক জন অ্যাক্সোলট্ল।
ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল আকস্মিক ভাবেই, বসন্তের এক সকালে। মোড় ঘুরতেই চার দিকের ধূসর রঙের মধ্যে এক চিলতে সবুজ হঠাৎ আমার চোখে পড়ে আমায় সিংহগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। সিংহ আর চিতাগুলোর সঙ্গে আমার বেশ একটা বন্ধুত্ব ছিল, তবে মাছ-ঘরের ওই গুমোট, স্যাঁতসেঁতে বাড়িটার ভিতর কোনও দিন যাইনি। সে দিন সাইকেলটাকে বাইরে রেখে আমি টিউলিপ ফুলগুলোকে দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সিংহগুলো কেমন গোমড়া, দুখি-দুখি হয়ে আছে, আর আমার চিতাটা ঘুমোচ্ছে। অতএব মাছ-ঘরেই যাব মনস্থির করে, ভিতরে গিয়ে বোকাটে দেখতে মাছগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, অ্যাক্সোলট্লগুলোকে কেমন মনে ধরে গেল। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
লাইব্রেরিতে গিয়ে অভিধান ঘেঁটে জানতে পারলাম যে অ্যাক্সোলট্ল আসলে ‘অ্যাম্বাইস্টোমা’ শ্রেণির এক ধরনের উভচর গিরগিটির ‘লার্ভাল স্টেজ’ বা কৃমি অবস্থা (জলজ প্রাণী, ওদের কানকো রয়েছে)। একটা বই দেখে জানতে পারলাম যে আফ্রিকায় নাকি দেখা গিয়েছে ওরা খরার সময়ে শুকনো খটখটে ডাঙায় দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে, আবার বর্ষা এলেই জলের তলায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। এও জানতে পারলাম যে প্রাণীগুলো মানুষের আহারযোগ্য।
এর পর থেকে প্রতি সকালেই ওদের দেখতে যেতে শুরু করলাম, কোনও কোনও দিন দুপুরবেলাও আবার যেতাম। মাছ-ঘরের প্রহরীটার মুখে আমার টিকিটটা নেওয়ার সময়ে একটা নির্বাক বিস্ময়ের হাসি ফুটে উঠত। আমি সোজা গিয়ে কাচের পাত্রটার সামনের লোহার রেলিংটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতাম। এতে অবাক লাগার বা অস্বস্তি হওয়ার কিছুই ছিল না, কারণ ওদের দেখার প্রথম মুহূর্ত থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমাদের মধ্যে কোথাও একটা কোনও যোগসূত্র আছে; কোনও এক নাম-না-জানা, হারিয়ে যাওয়া গভীর চেতনা আমাদের পরস্পরের দিকে টেনে রেখেছে। ওরা সবাই মিলে ওই ছোট্ট, সংকীর্ণ কাচের পাত্রটার তলায় (ঠিক কতটা সংকীর্ণ আর কতটা অসহনীয়, সেটা একমাত্র আমারই জানার ক্ষমতা আছে) শ্যাওলা আর নুড়িপাথরের ভিড়ে গাদাগাদি করে পড়ে থাকত। ন’জন ছিল ওরা, বেশির ভাগই কাচের গায়ে মাথা লাগিয়ে, সোনালি চোখগুলো মেলে কাছাকাছি কেউ এলে তাদের দিকে চেয়ে থাকত। মনে মনে একটাকে বেছে নিলাম, ওই ডান দিকে যেটা বাকিদের থেকে কেমন একটু আলাদা থাকতে চাইছে। দেখলাম ছোট্ট, ইঞ্চি ছয়েক লম্বা, অনেকটা টিকটিকির মতো দেখতে একটা গোলাপি শরীর, আর তার শেষপ্রান্তে অসম্ভব সূক্ষ্ম একখানা মাছের মতো লেজ, ওটাই আমাদের শরীরের সবচেয়ে কোমল, স্পর্শকাতর অংশ। তার পর আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটোর দিকে নজর দিলাম। আলপিনের মতো দুটো ছোট ছোট স্বচ্ছ, সোনালি ছিদ্র, প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই, তবু ঠিক তাকিয়ে আছে, আমাকে যেন অনুমতি দিচ্ছে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরও গভীরে চলে যাওয়ার, ওই সোনালি আস্তরণটা ছাড়িয়ে গিয়ে মনের গভীরের আবছায়া রহস্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার। ক্বচিৎ-কদাচিৎ একটা করে পা নড়ে উঠছিল। আসলে নড়াচড়া জিনিসটা আমাদের খুব একটা ভাল লাগে না। কাচের পাত্রটা এতই ছোট, যে নড়তে গেলেই অন্যের সঙ্গে লেজের বা মাথার ধাক্কা লেগে যায়, সেই থেকে হাজার অসুবিধা, হাজার ঝগড়া, ক্লান্তি, পরিশ্রম... চুপচাপ, নিথর হয়ে থাকলে সময়টা কেমন তাড়াতাড়ি কেটে যায়। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
ওদের এই নীরবতা, এই নিথরতা, এটাই আমায় সেই প্রথম দিন থেকে আগ্রহী করে তুলেছিল। আমার অবচেতনে ওদের গোপন ইচ্ছেটা আবছা বুঝতে পেরেছিলাম মনে হয়: স্থবির ঔদাসীন্যের মধ্যে দিয়ে স্থান-কালের সমস্ত হিসেবকে নস্যাৎ করে দেওয়ার ইচ্ছে। পরে আরও ভাল করে বুঝলাম; ওদের কানকোগুলোর নড়ে ওঠা, পাথরের উপরে সূক্ষ্ম পাগুলোর সতর্ক বিচরণ, আচমকা সাঁতরে বেড়ানো— আমার কাছে বার বার প্রমাণ করে দিল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে নিঃসাড় আলস্যের মধ্যে ওরা পড়ে থাকে, সেই আলস্যের থেকে মুক্তি পাওয়ার সামর্থ্য কিন্তু ওদের আছে। তবে অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল: চোখগুলো। ওগুলো আমাকে এক সম্পূর্ণ অন্য জীবনের, অন্য চেতনার, অন্য দৃষ্টিভঙ্গির খবর পৌঁছে দিত। ওই সোনালি বিন্দুগুলোকে আরও ভাল করে দেখার জন্য কাচের গায়ে নিজের মুখটা লাগিয়ে রাখতাম আমি, এই গোলাপি প্রাণীগুলোর মনের ভিতরের ভীষণ অলস, ভীষণ নিরালা জগৎটার প্রবেশপথ মনে হত ওদের চোখগুলোকে। সেগুলো এক নরম এবং ভয়ানক আলোর আভায় জ্বলত, এক অকল্পনীয় গভীরতার অতল থেকে আমার দিকে টানা তাকিয়ে থাকত, মাঝে মাঝে মাথা ঝিমঝিম করত আমার।
ওরা কিন্তু জানত, আর আমিও জানতাম। আমার মুখটা মাছ-ঘরের কাচের গায়ে লাগিয়ে রেখেছিলাম, কাচের পাশেই একটা অ্যাক্সোলট্লের নিথর মুখটা ভীষণ কাছ থেকে চোখে পড়ল আমার। কোনও পরিবর্তন ছাড়াই, একটুও অবাক না হয়ে, আমি হঠাৎ আমার নিজের মুখটাই দেখতে পেলাম, পাত্রের বাইরে, কাচের অন্য দিকে। তার পর আমার মুখটা সরে গেল, তখন আমি বুঝতে পারলাম কী হয়েছে!
একটাই ব্যাপারে একটু অদ্ভুত লাগে; এখনও সেই একই রকম ভাবনাচিন্তা করে যাওয়া, এখনও জ্ঞান থাকা। এটা প্রথম বার বুঝতে পারার মুহূর্তটা ছিল অদ্ভুত; এক জন মানুষকে যদি জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়, তবে কবরের মধ্যে প্রথম জেগে উঠে তার যে আতঙ্কটা হয়, সেই রকম। বাইরে আবার আমার মুখটা কাচের কাছে ফিরে এল। দেখলাম ঠোঁটগুলো সংকুচিত হয়ে আছে অ্যাক্সোলট্লদের গতিবিধি বোঝার আপ্রাণ চেষ্টায়। আমি নিজে অ্যাক্সোলট্ল হয়ে গিয়েছি, তাই তখনই বুঝতে পারলাম যে আমাদের গতিবিধি বোঝা সম্ভব নয়। লোকটা তো কাচের পাত্রের বাইরে থাকে, ওর ভাবনাচিন্তাগুলো পাত্রের বাইরের পৃথিবীর ভাবনাচিন্তা। আতঙ্কটা জাঁকিয়ে বসল এবং বুঝতেও পারলাম সেই সঙ্গেই, আমি একটি অ্যাক্সোলট্লের শরীরে বন্দি, তার সঙ্গে আমার দেহ এক হয়ে গেলেও আমার মনটা এখনও মানুষের মতোই রয়ে গিয়েছে, একটি অ্যাক্সোলট্লের মধ্যে আমায় জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছে, এখন থেকে আমায় এই অচেতন প্রাণীগুলোর মধ্যেই থাকতে হবে। কিন্তু এই আতঙ্কটা একটু পরেই কেটে গেল, এক পাশে একটু নড়তে গিয়ে একটা পা যখন আমার মুখের সঙ্গে লেগে গেল, দেখলাম আমার পাশে আর এক জন অ্যাক্সোলট্ল আমার দিকেই তাকিয়ে। বুঝতে পারলাম, সে-ও সব জানে। কোনও কথোপকথন সম্ভব ছিল না, তবুও বুঝতে পারলাম। কিংবা হয়তো ওর মধ্যেও আসলে আমিই ছিলাম।
লোকটা প্রায়ই ফিরে আসত, তবে আজকাল একটু কম আসে। মাঝে মাঝে কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। আজকাল বোধ হয় ওর আর আমাদের বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই, নেহাত অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তাই আসে। আমি যেহেতু ভাবনা ছাড়া কিছুই পারি না, লোকটাকে নিয়ে প্রচুর ভেবেছি। আমার খালি মনে হয়, প্রথম প্রথম আমাদের মধ্যে অনেক আদানপ্রদান চলত। যে রহস্যটা লোকটাকে পাগল করে দিচ্ছিল, সেই রহস্যটার সঙ্গে তখন একদম একাত্ম বোধ করত ও। কিন্তু সেতুগুলো এখন ভেঙে গিয়েছে। কারণ যা ছিল ওর সর্ব ক্ষণের চিন্তা, আজ সেটা নিছক একখানা অ্যাক্সোলট্ল, মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। মনে হয় গোড়ার দিকে একটা কোনও ভাবে— শুধু ওই একটা বিশেষ কোনও ভাবেই— আমার লোকটার কাছে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল, আমাদের আরও বেশি বোঝার ইচ্ছেটাকে ওর মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার একটা উপায় ছিল। কিন্তু এখন আমি চিরকালের মতো অ্যাক্সোলট্ল, আর আমার ভাবনাগুলো যদি মানুষের মতো হয়, তার একমাত্র কারণ, প্রতিটি অ্যাক্সোলট্লের গোলাপি, পাথুরে চেহারার তলায় ভাবনাগুলো আসলে মানুষের মতোই। আমার মনে হয় এই কারণেই সেই গোড়ার দিকে, যখন আমি ওই লোকটা ছিলাম, ওকে কিছু একটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। আর এই অন্তিম একাকিত্বে, যখন লোকটা আর আসে না, তখন এই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিই, হয়তো লোকটা আমাদের নিয়ে একটা গল্প লিখবে; মনে মনে নিজের একটা গল্প তৈরি করছে মনে করে, লোকটা হয়তো এই সবই লিখে ফেলবে।
|
(সংক্ষেপিত)
অনুবাদ: কবীর চট্টোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|