পেনাল্টি বক্সের মাথায় চুনের দাগের ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে নীল বোরখায় ঢাকা একটা চেহারা। পিছন থেকে একটি লোক তার মাথায় ঠেকিয়ে রেখেছে কালাশনিকভ রাইফেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই গুলি খেয়ে বোরখা ঢাকা মূর্তিটা ধপ করে পড়ে যাবে ওই ঘাসহীন ময়দানে।
কাবুলের গাজি স্টেডিয়াম। সালটা ১৯৯৯। স্বামীকে হত্যার দায়ে জারমিনা নামে ওই মহিলাকে এ ভাবেই প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল শাসক তালিবান। গোপনে তোলা সেই ঘটনার ভিডিও দেখে শিউরে উঠেছিল বিশ্ব।
২০১২, দিল্লি। অম্বেডকর স্টেডিয়ামের গ্যালারি দাপাচ্ছে লাল ট্র্যাকসুট পরা উচ্ছল কয়েকটা মেয়ে।
হিজাবে ঢাকা মাথা। শর্টস পরে ফুটবল খেলার ছাড়পত্র দেশ এখনও দেয়নি। তাই গোটা পা ঢাকা ট্র্যাকসুটের লোয়ারে। গ্যালারিতে ওয়ার্ম আপের ফাঁকে ওরা থেকে থেকে ফেটে পড়ছে বয়সোচিত চাপল্য আর উৎসাহে।
সেই কাবুলেরই মেয়ে ওরা। আফগানিস্তানের রাজধানীর রাবেয়া-এ-বালখি গার্লস স্কুলের ফুটবল দল। সম্প্রতি যারা দিল্লিতে এসে খেলে গেল অনূর্ধ্ব ১৭ সুব্রত কাপে।
মেশিনগান, বারুদগন্ধ, ক্ষতবিক্ষত ইমারতের সারি আর তালিবানি শাসনের ইতিহাসকে ড্রিবল করতে করতে দৌড় ওই এক ঝাঁক দামালের। লক্ষ্য, ইতিহাসটাকে বদলে দেওয়া। ১৯৯৬-এ তালিবান কাবুলের দখল নেওয়ার পর খেলার দুনিয়াটাও তাদের হাজারো ফতোয়ার হাত থেকে রেহাই পায়নি। যার অন্যতম ছিল, মেয়েদের জন্য সব রকম খেলার দরজা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া।
দেড় দশকেরও বেশি দীর্ঘ একটা অধ্যায়ের পর অম্বেডকর স্টেডিয়ামে সেই দেশেরই কিশোরী ফুটবল দল। যার অধিকাংশ সদস্যই তালিবানি শাসনের দিনগুলোয় হয় জন্মায়নি, না হয় নিতান্তই শিশু। এখন কি ওরা সত্যিই ‘বাঁধনছাড়া’?
ঠিক তা-ও নয়। দলের অধিনায়ক জারাফ সান ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলছিল, “আমাদের এখনও স্কুল চত্বরের বাইরে খেলা বারণ। কয়েক বার চেষ্টা করে বিপদ হয়েছে।” কী বিপদ, খোলসা করেনি জারাফ। শুধু বলেছিল, “এখন তো অনেকটাই বদলেছে পরিস্থিতি। কিছু দিন আগেও বলা হত, মুসলমান মেয়েদের কোনও খেলারই অধিকার নেই। কিন্তু এখন স্কুলের ভিতরে আমরা শুধু ফুটবল নয়, ভলিবল-বাস্কেটবলও নিয়মিত খেলি। তবে মাঠে পুরুষদের প্রবেশাধিকার নেই।” |
তালিবান সরকার তো নেই। তা হলে এখনও কেন এমন বিধিনিষেধ? নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাস সূত্র ব্যাখ্যা দিচ্ছে, এই সব নিয়মের অনেকটাই আসলে মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। হামিদ কারজাই সরকার মনেপ্রাণে চায়, ‘পরিবর্তন’ আসুক। কিন্তু তালিবানের চোরাগোপ্তা হামলা তো বন্ধ হয়নি। স্কুল চত্বরে বা স্টেডিয়ামে মহিলা খেলোয়াড়দের তবুও নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব। উঠোনে বা খোলা মাঠে খেলতে গেলে যদি বিপত্তি ঘটে!
ভারতীয় যোজনা কমিশনের কর্তা অমিতাভ রায় ডেপুটেশনে গিয়েছিলেন কারজাই সরকারের অর্থনৈতিক বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে। তিনি বললেন, “খেলাধুলোর প্রচলনটা মূলত শহুরে মধ্যবিত্তদের
মধ্যে। এবং সেটা কাবুলকেন্দ্রিক। কারণ, রাজধানীতে নিরাপত্তা বেশি।”
আসলে সাহসী বদলটা ঘটানো হচ্ছে খুব মেপেজুপে, ধাপে ধাপে। রাস্তায় বেরোনোই বন্ধ ছিল তালিবান জমানায়। আজ হিজাবে মাথা ঢেকে হলেও মহিলারা ফুটবল তো খেলছেন। সফরকারী স্কুল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড মদিনা বলছিল, “ভারতে এসে বাজারে-রাস্তায় ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারছি। এমনটা দেশে হয় না। তবে আমি তো ফুটবলটা খেলতে পারছি। যখন ছোট ছিলাম, আমার দিদিদের স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জানলা দিয়ে উঁকি পর্যন্ত দিতে পারত না ওরা।”
আতঙ্ক যে এখনও পিছু ছাড়ে, এমন নয়। বছরখানেক আগে আফগান জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের তৎকালীন অধিনায়ক খালিদা পোপাল এক সাক্ষাকারে বলেছিলেন, খেলা ছাড়ার হুমকি দিয়ে এসএমএস আসে তাঁর কাছে। বাড়ির লোকেরাও বলেন, ঝামেলায় না গিয়ে খেলা ছেড়ে দিতে। কিন্তু ফুটবল ছেড়ে তিনিই বা থাকেন কী করে?
২০০৭ সালে মূলত স্কুলের বাছাই করা মেয়েদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল আফগান জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। ‘আইস্যাফ’ বাহিনীর মহিলা দলের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ খেলেছিল তারা। আর আজ জার্মানি, জর্ডন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সফর করে ফেলেছে সেই দল। খেলেছে ‘সাফ’ টুর্নামেন্টেও। ওই গাজি স্টেডিয়ামই আজ তাদের ‘হোম গ্রাউন্ড’।
আর শুধু ফুটবল কেন? কারজাই সরকারের উৎসাহে কুংফু, তাইকোন্ডো, বাস্কেটবলও আফগান মহিলাদের মধ্যে এখন তুমুল জনপ্রিয়।
বলে রাখা যাক, ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে আফগানিস্তানকে যে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, তার কারণ ছিল তালিবান সরকারের মহিলাদের উপর দমন-পীড়ন ও মহিলাদের খেলাধুলোয় নিষেধাজ্ঞা জারি। তালিবানের পতনের পর অলিম্পিকের দরজা আবার খোলে। ২০০৮ বেজিং এবং সদ্যসমাপ্ত ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে তাইকোন্ডোতে পরপর ব্রোঞ্জ জেতেন আফগান যুবক রোহুল্লা নিকপাই। আফগানিস্তানের সবেধন নীলমণি এই দু’টি মাত্র অলিম্পিক পদকই যেন বদলের পথে দু’টো বিশাল পদক্ষেপ।
দিন যত যাচ্ছে, খেলাকে আঁকড়ে ধরে ততই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটা পাল্টা জেহাদের ডাক দিচ্ছে আফগানিস্তান। সেই জেহাদে মদত রয়েছে সরকারের। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত শাহিদ মহম্মদ আবদালি সম্প্রতি বলেছিলেন, “আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। আমরা খুশি যে, ভারতীয় বন্ধুরা সে সবের খোঁজ নিতে শুরু করেছেন। আমরা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পেরেছি।” দূতাবাস-সূত্রে বলা হচ্ছে, এই ‘মোড় ঘোরানো’র লক্ষ্যে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ভারত ও চিনকে পাশে পেতে চাইছে কারজাই সরকার। তারা মনে করছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের নিয়মিত বিদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
তাই আফগান কিশোরীদের ফুটবল দল যখন ভারত সফরে, তখনই টি-২০ বিশ্বকাপ খেলতে সে দেশের জাতীয় ক্রিকেট দল শ্রীলঙ্কায় হাজির। প্রথম ম্যাচে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিরা মুখোমুখি হলেন সেই আফগানিস্তানের। যাদের ক্রিকেট বোর্ডটার জন্ম ১৯৯৫-এ। তালিবান জমানায় প্রথমে নিষিদ্ধ হয়েও পরে ছাড় পেয়েছিল ক্রিকেট।
আর এখন? আফগানিস্তানের পকেটে ওয়ান-ডে খেলার আইসিসি-স্বীকৃতি, গোটা দেশে তিনশোরও বেশি ক্রিকেট ক্লাব।
অথচ একটা সময়ে ফুটবলই ছিল বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু দেশে পরপর অশান্তির জেরে ১৯৮৪ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলতে পারেনি আফগানিস্তান। ২০১১-এ সেই দেশই ‘সাফ’ টুর্নামেন্টে রানার্স। প্রথম জাতীয় ফুটবল দল গড়া হয় ১৯২২-এ, পরের বছরই তৈরি হয় গাজি স্টেডিয়াম। তালিবান জমানায় এই স্টেডিয়ামগুলোই হয়ে গিয়েছিল প্রকাশ্য বধ্যভূমি। ২০১১-এ কৃত্রিম ঘাস বসিয়ে ভোল পাল্টে দেওয়া হয়েছে গাজি স্টেডিয়ামের।
এমনই ভোলবদলের স্বপ্ন দেখে ‘কাবুল গল্ফ ক্লাব’ আফগানিস্তানের একমাত্র গল্ফ কোর্স। এখানে সবুজ নেই, আছে তেল আর বালি মেশানো বাদামি প্রান্তর। ১৯৬৭ সালে তৈরি এই গল্ফ কোর্স বারবার যুদ্ধের ছোবলে বন্ধ হয়েছে। মাইন-স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে ক্লাব হাউস আর গল্ফের মাঠ। পরিত্যক্ত ট্যাঙ্ক আর রকেট লঞ্চারের জঞ্জাল পরিষ্কার করে ২০০৪-এ ফের দরজা খোলে কাবুল গল্ফ ক্লাব। সেখান থেকেই উঠে আসা দুই গল্ফার খেলে এসেছেন ২০১০ এশিয়াডে। এখন চলছে মেরামতির জন্য তহবিল সংগ্রহ। ‘হেডমাস্টার’ মহম্মদ আফজল আব্দুল মাটি কামড়ে পড়ে আছেন অনেক আশা
ও প্রত্যয় নিয়ে।
জারান-মদিনাদের চোখেও সেই প্রত্যয়। সুব্রত কাপের ফাইনালে ওরা উঠতে পারেনি। কিন্তু সেটা নিছক তথ্য। দিনবদলের আফগানিস্তানে ওদের ‘ঐতিহাসিক’ দৌড়ের গল্প কোনও স্কোরবোর্ড লিখতে পারবে না। বালিশের নীচে মেসি-রোনাল্ডোর ছবি রেখে ওরা স্বপ্ন দেখে। ওদের গোলকিপার রাইহিনাকে শক্তি দেয় ‘চক দে ইন্ডিয়া’র শাহরুখ খানের টিম। ওরা প্রশ্ন তোলে, “সাইনা নেহওয়াল, সানিয়া মির্জারা পারলে আমরা পারব না কেন?”
ছাই থেকে তো উঠে আসছে এই আফগানিস্তান। এ দেশের ‘ফিনিক্স’ ডাকনামটা খুব বেমানান হবে? |