প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্লেটো ‘সিমপোজিয়াম’ গ্রন্থে শুনিয়েছিলেন সে কাহিনি। লিঙ্গের জন্মকথা। লিঙ্গের নয়, বলা ভাল আধুনিক লিঙ্গ-পরিচয়ের। ওই বইতে অ্যারিস্টোফেনিস জানাচ্ছেন, মানুষ একদা ছিল তিন রকমের। প্রত্যেক রকম আবার জোড়ায় বাঁধা। অর্থাৎ, দ্বৈত সত্তা প্রত্যেকের। এক রকম মানুষ দুই পুরুষের জোট। আর এক রকম আসলে দু’জন নারীর মিলিত রূপ। আর, তৃতীয় প্রজাতি একাধারে পুরুষ ও নারী। পুরুষ-পুরুষ, নারী-নারী এবং পুরুষ-নারীর অটুট বন্ধন আসলে দুই লিঙ্গের দুর্নিবার আকর্ষণের পরিণাম। অ্যারিস্টোফেনিস বলছেন, এমন আকর্ষণে আবদ্ধ মানুষ মহা শক্তিমান। তাই তাদের দেখে ভয় পেলেন দেবতারা। পাছে তাদের প্রভুত্ব চলে যায়! দেবতাদের সম্রাট জিয়ুস তরবারিতে ছিন্ন করলেন বন্ধন। দ্বৈত সত্তা হারিয়ে মানুষ হল একা। পুরুষ অথবা নারী। ভিন্ন দুই প্রজাতি। বন্ধনের গ্রন্থি ছিঁড়ে যারা দুর্বল। তাই, অ্যারিস্টোফেনিসের ব্যাখ্যা, পুরুষ ও নারীর মাঝে তীব্র কামনা। মর্ত্যভূমে এখনও দুয়ে মিলে হতে চায় একাকার।
যে কোনও লোককাহিনির মতো এ গল্পও মিথ্যে। তবে, যে কোনও লোককাহিনির মতো, এতেও লুকোনো আছে সত্যের আভাস। লিঙ্গভেদ যে শুধু নারীপুরুষে সীমাবদ্ধ নয়, বিস্তৃত সেই চৌহদ্দির বাইরেও, আর ক্ষীণ যে দুইয়ের বিভাজন রেখাটি এই বিজ্ঞান-সমর্থিত অধুনা-অভিজ্ঞান মনে করায় ওই গল্প।
লিঙ্গ-পরিচয় ঘিরে এমন সব গল্প হয়তো হাস্যকর। তবু তা মনে পড়ল সাম্প্রতিক দু’টি খবরের সূত্রে। একটি খবর দেশের। অন্যটি বিদেশের। দেশি খবরের কেন্দ্রে পিংকি প্রামাণিক। এশিয়া মহাদেশে মহিলাদের ৪০০ মিটার, ৮০০ মিটার এবং ১৬০০ মিটার রিলে রেসে বহুবার সোনা বিজয়িনী। দু-বছর আগে এক পথ দুর্ঘটনায় অ্যাথলেটিকস কেরিয়ার শেষ না হলে, হয়তো এ বার লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিযোগী হিসেবে দেখা যেত তাকে। সেই পিংকি সম্প্রতি কিছু দিন কাটালেন জেল-হাজতে। এক অভিযোগের ভিত্তিতে। অভিযোগ তিরিশ বছর বয়সি এক মহিলাকে ধর্ষণের। সেই মহিলার দাবি, পিংকি নিজের লিঙ্গ-পরিচয় আড়াল করে রেখেছেন। তিনি আসলে পুরুষ। অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া-র অভিমত, পিংকির দেহে পুরুষ-সুলভ হরমোন রয়েছে বেশি পরিমাণে। কিন্তু, তাতে প্রমাণ হয় না তিনি পুরুষ। আদালতের রায়, ধর্ষণের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে টেকে না। বিদেশি খবরের কেন্দ্রেও এক মহিলা অ্যাথলিট। কাস্টার সেমেনিয়া। লন্ডন অলিম্পিকে মেয়েদের ৮০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় স্থানাধিকারিণী। হায়, রূপা জিতেও বিতর্ক ছাড়েনি দক্ষিণ আফ্রিকার ২১ বছর বয়সি এই অ্যাথলিটকে। একাধিক বিশেষজ্ঞ (যাদের মধ্যে আছেন প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নেরা) অনুমান করছেন কাস্টার ইচ্ছে করে প্রথম হননি। কেন এমন অভিযোগ?
আসলে, ৮০০ মিটার দৌড়ে ৬০০ মিটার পর্যন্ত কাস্টার ছিলেন না এগিয়ে। পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞদের মনে হচ্ছিল যেন প্রতিযোগিনী চান না নিজেকে উজাড় করে দিতে। এমন অবস্থা থেকে শেষ ২০০ মিটারে উন্নতি। তবে, সেটা ৬০০ মিটারে ঘাটতি মুছে সবাইকে পেছনে ফেলার মতো দারুণ কিছু নয়। দৌড়ে প্রথম রুশ প্রতিযোগিনী মরিয়া সাভিনোভা। তাঁর সময় ১ মিনিট ৫৬.১৯ সেকেন্ড। কাস্টার দ্বিতীয়। সময় ১ মিনিট ৫৭.২৩ সেকেন্ড।
অলিম্পিকে সবার স্বপ্ন যেখানে যখন সোনা, তখন কাস্টার কেন দৌড়োবেন রূপার আশায়? বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা: কাস্টার সোনার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়েছেন স্রেফ বিতর্ক থেকে বাঁচতে। যে বিতর্ক তাকে তাড়া করছে ২০০৯ সালে বার্লিনে ওয়র্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা থেকে। ওখানে ৮০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছিলেন কাস্টার। সময় লেগেছিল ১ মিনিট ৫৫.৪৫ সেকেন্ড। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ২.৪৫ সেকেন্ড কম। এতে শুরু হয়েছিল শোরগোল। কাস্টার মহিলা না পুরুষ? প্রশ্ন এত জোরালো হয়ে দাঁড়ায় যে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন (আই এ এ এফ) নির্দেশ দেয়, কাস্টারের লিঙ্গ-পরিচয় নির্ধারণ করতে হবে। যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন কোনও প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারবেন না তিনি। লিঙ্গ পরীক্ষার ফল ঘোষণা না করলেও দশ মাস বাদে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় আই এ এ এফ। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিযোগী হিসেবে লন্ডন অলিম্পিকে যোগ দেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এখানে সোনা জিতে আবার পুরনো বিতর্কে জড়াতে চাননি কাস্টার। তাই চেষ্টা করেননি ৬০০ মিটারে নিজেকে এগিয়ে রাখার।
অর্থাৎ, পুরনো বিতর্ক থেকে কাস্টার এ বার নতুন বিতর্কে। যদিও তিনি ঘোষণা করেছেন, বিশেষজ্ঞদের ধারণা ভুল, ওলিম্পিকে যোগ দিয়ে কেউ সোনার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেয় না, তিনি দৌড়েছেন সাধ্যমতো, তবু তার সাফাই মুছে ফেলতে পারেনি নতুন বিতর্ক। পারেনি, কারণ, বিতর্কের মূল বিষয়টা এখানে রীতিমতো কূট। কী? নর ও নারীর লিঙ্গ-পরিচয়। পিংকি এবং কাস্টার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ওই পরিচয়ের ভেদরেখাটি বড় অস্পষ্ট।
বহুল প্রচারিত ব্যাখ্যায় অবশ্য ও ব্যাপারে নেই কোনও জটিলতা। নিচু ক্লাসের পাঠ্যবইতে লেখা থাকে, পুরুষ ও মহিলার ভেদাভেদ ক্রমোজোমে। পুরুষ মানে একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রমোজোম (এক্স-ওয়াই)। আর, মহিলা মানে দু’টি এক্স ক্রমোজোম (এক্স-এক্স)। হায়, ব্যাপারটা যদি এত সহজ হত! আসলে, ওয়াই ক্রমোজোমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটা জিন বড় ভূমিকা নেয় নারী-পুরুষ ভেদাভেদ রচনায়। মাতৃজঠরে ভ্রূণ বড় হওয়ার সময় ওই জিন যদি তার কাজ না করে, তা হলে সেই শিশুর দেহে নারীর লক্ষণ প্রকট হয়। আবার, ওই জিন কখনও সখনও এক্স ক্রমোজোমেও উপস্থিত থাকে। ফলে এক্স-এক্স ক্রমোজোম সংবলিত ভ্রূণ, যার ভবিতব্য মেয়ে হওয়া, তার দেহে পুরুষ-সুলভ লক্ষণ বড় বেশি দেখা যায়। অনেকে ভাববেন, জটিলতা এড়াতে যৌনাঙ্গ নির্ণায়ক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। নাহ্, তাতেও মুশকিল। ভ্রূণাবস্থায় একই জিনিস যেহেতু পরে হয়ে দাঁড়ায় পুরুষ অথবা স্ত্রী যৌনাঙ্গ, তাই বেড়ে ওঠার গোলমালে কোনও মানুষের যৌনাঙ্গ হতে পারে ও দুয়ের মাঝামাঝি কিছু। সে মানুষটি তা হলে যে গণ্য হতে পারেন ওই দুয়ের কোনও একটা!
হয়তো এ সব কারণে চলে আসে হরমোন পরীক্ষার কথা। কিন্তু, তা-ই বা কতটা নির্ভরযোগ্য? পুরুষ এবং নারীদেহ উৎপাদন করে একই হরমোন। প্রভেদ কেবল পরিমাণে। তবে, কোনও মহিলার দেহে পুরুষালি হরমোনের মাত্রা বেশি থাকলেই তাকে পুরুষ বলা যায় না। অধিকাংশ মহিলা অ্যাথলিটের দেহে ওরকম হরমোন বেশি। ওরা সত্যিই গড়পড়তা মহিলা নন। তা বলে কি ওদের প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দিতে হবে? তা হলে তো বেশি লম্বা মহিলা কিংবা খুব বেঁটে পুরুষ অ্যাথলিট যোগ দিতে পারবেন না কোনও প্রতিযোগিতায়।
লিঙ্গ-পরিচয়ের অস্পষ্ট ভেদরেখা বিজ্ঞানকে দাঁড় করায় কিছু গূঢ় প্রশ্নের সামনে। প্রাণিজগৎ জুড়ে কেন স্ত্রী এবং পুরুষ প্রজাতির ভিড়? আজ থেকে দুশো কোটি বছর আগে হঠাৎ কেন উদ্ভব হল ওই দুই জাতের? বংশবৃদ্ধি অর্থাৎ সন্তান উৎপাদনে কেন প্রয়োজন দুই জাতের মিশ্রণ? ব্যাকটেরিয়া, কিংবা দু-একটা উদ্ভিদ, তো বংশবিস্তার করে নিজে-নিজে, অন্যের প্রয়োজন বিনে; তা হলে পশুপাখি মানুষ কেন চলে ভিন্ন নিয়মে? মোট কথা, হোয়াই সেক্স?
উত্তর সন্ধানে ব্যস্ত বিজ্ঞান। আসছে তত্ত্ব, নানা ব্যাখ্যা। কোনওটিই, বলা বাহুল্য, নিশ্ছিদ্র নয়। দেড়শো বছর আগে লিখেছিলেন চার্লস ডারউইন: ‘যৌনতার চূড়ান্ত কারণ আমরা কিছুমাত্র জানি না। নতুন জীব সৃষ্টিতে কেন যে প্রয়োজন দুটি যৌন উপাদান। বিষয়টা এখনও অন্ধাকারে ঢাকা।’
সে অন্ধকার আজও কাটেনি। |