সম্পাদকীয়...
হাসি ও কান্না
ম্প্রতি চিনের এক নিরাপত্তা-কর্তাকে তাঁহার পদ হইতে বহিষ্কার করা হইল এই অভিযোগে, তিনি ভয়াবহ বাস-দুর্ঘটনার স্থলে দাঁড়াইয়া মুচকি হাসিয়াছেন। এ কথা অবশ্যই ঠিক, আবেগ-প্রকাশের একটি স্থান-কালের হিসেব থাকা দরকার। যে গৃহে সদ্য মৃত্যু ঘটিয়াছে, আমি সেখানে গিয়া অট্টহাস্য করিতে পারি না। তাহা শোকসন্তপ্তদের আবেগকে অশ্রদ্ধা করে। দুঃখের ঘটনাটির গাম্ভীর্যকে লঘু করিয়া দেয়। যদি রাষ্ট্রের তরফ হইতে সাধারণ মানুষের কোনও বিপদ বা বৃহৎ বেদনার সম্মুখে গিয়া কেহ দাঁড়ান, তাঁহার দায়িত্ব বহু গুণ বর্ধিত হয়, তাঁহাকে নিছক ব্যক্তি হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়, তাঁহার ব্যবহারগুলি সাধারণ পরিস্থিতির তুলনায় অধিক গুরুত্ব লইয়া লক্ষ করা হয়। দুর্ঘটনার জায়গায় গিয়া তিনি হাসিলে, মনে হইতে পারে, রাষ্ট্র নাগরিকগণের প্রাণহানিকে যথেষ্ট বিষাদের কারণ হিসাবে দেখিতেছে না। কিন্তু এ কথাও ঠিক, মানুষের হৃদয় সর্ব ক্ষণ সমষ্টির ব্যাকরণ মানিয়া চলিতে পারে না। আপনজনের মৃতদেহ সম্মুখে রাখিয়াও মানুষ রসিকতায় হাসিয়া ওঠে। নতমুখে দু’মিনিট মৌন পালন করিতে গিয়া, সম্পূর্ণ অকারণে কাহারও হাসি পাইয়া যায়। এই হাসি সভ্যতার অনুশাসন অনুযায়ী রুচিসম্মত নহে, বুঝিয়া কেহ হয়তো তাহাকে তিরস্কার করিয়া উঠেন, কিন্তু আক্রমণ করেন না। কারণ হাস্য ওই মুহূর্তে ব্যক্তিটির নিজ নিয়ন্ত্রণেরও বাহিরে। মনুষ্য-স্বভাবের এ উচ্চাবচগুলির প্রশ্রয় দিতে না শিখিলে নিজের বিবেচনার অভাবেরই পরিচয় দেওয়া হয়। সকলকেই, বিশেষত কর্তৃপক্ষকে, বুঝিতেই হইবে, মনুষ্য এই কারণেই যন্ত্র নহে। তাহার মৃদু কক্ষচ্যুতির সম্ভাবনাকে সে সর্বদাই বহন করিয়া চলে। চিনের ওই কর্তা ভুল স্থানে ও ভুল সময়ে হাসিয়াছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাহাকে তৎক্ষণাৎ ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া, পার্টি ও অফিসের সকল পদ হইতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত লইলে, জনগণের আবেগের প্রতি যতটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়, ওই মানুষটির স্বাধীনতার প্রতিও ততটাই অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। মনে পড়িয়া যাইতে পারে, উত্তর কোরিয়ার সর্বময় কর্তা কিম জং ইল-এর সাম্প্রতিক দেহান্তের পর, তাঁহার স্মরণে যে শোকসভা ও শোকমিছিলগুলির আয়োজন করা হইয়াছিল, তাহাতে কোন নাগরিক কতটা আকুল হইয়া রোদন করিতেছেন, তাহার কড়া-ক্রান্তি হিসাব রাখা হইয়াছিল। যিনি বা যাঁহারা কাঁদেন নাই, বা কাঁদিলেও তাহার উপস্থাপনায় যথেষ্ট তীব্র শোক দর্শাইতে পারেন নাই, তাঁহাদের ছয় মাস লেবার-ক্যাম্পে সশ্রম দণ্ড প্রদান করা হয়। এই কাজ স্বৈরাচারের সহিত সমঞ্জস। মানুষের কাঁদিবার অধিকারের মধ্যে তাহার না-কাঁদিবার অধিকারও নিহিত। এমনকী প্রবল বেদনা ও চারিপাশের উতরোল দুঃখ প্রদর্শনের মধ্যেও কেহ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে। হয়তো তাহার শোক প্রকাশের ধরনটিই ওই রূপ, কিংবা সেই মুহূর্তে সে শোকাকুল হইয়া উঠিতে পারিতেছে না। এই আবেগগুলি তো মানুষ ইচ্ছা করিলেই উৎপাদন করিতে পারে না, হাসি ও কান্না মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এইগুলি মুষ্টি উত্তোলন বা স্লোগান-চিৎকারের ন্যায় আদেশ করিয়া প্যারেডের অঙ্গ হিসাবে কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করিয়া দিতে পারেন না। হয়তো উহাই মদমত্ত ক্ষমতার গাত্রদাহের কারণ। সে মানুষকে কোতল করিতে পারে, কিন্তু তাহার ভাবনাস্রোতকে মুঠি চাপিয়া ধরিতে পারে না। তাই, মানুষকে গোটাগুটি নিয়ন্ত্রণের তাড়নায় রাষ্ট্র মাঝে মাঝেই সেই এলাকাগুলিকে আক্রমণ করে, যাহা ব্যক্তির নিজেরও অজানা অঞ্চল। হৃদয় এক গহন অনিশ্চিত বস্তু, তাহা বাদ্যযন্ত্র নহে, অমুক চাবি টিপিলেই তমুক সুর বাহির হইবে। ইহাই মনুষ্যের তাবৎ সুন্দরতা ও রহস্যময়তার কারণ। হয়তো সেই কথাটি বিস্মৃত হওয়াই দমনের নেশার ধর্ম। সে উপলব্ধি করিতে চায়, অলৌকিক উপায়ে উহাকে ফরমায়েশি যন্ত্রে রূপান্তরিত করিবার চাবি তাহার হস্তে আসিয়া পড়িয়াছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.