পাত্রী পড়ে ক্লাস ফাইভে। অথচ রেজিস্ট্রি করে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে! ‘আমি পড়তে চাই। পড়াশোনা করে চাকরি করতে চাই। বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে’ শুক্রবার বসিরহাট থানায় বড়বাবুর সামনে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে দম নেয় সেই ছাত্রী। জানায়, জোর করে তার ‘বিয়ে দিয়েছে’ বাবা-মা।
পাশে তখন দাঁড়িয়ে মেয়ের মা। নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাবা অবশ্য বেপাত্তা। যে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ‘বিয়ে’ দিয়েছিলেন, তাঁরও খোঁজ নেই। বসিরহাট থানার আইসি শুভাশিস বণিক বলেন, “কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখে রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিয়ের বিরুদ্ধে নাবালিকাদের রুখে দাঁড়ানোর গল্প শুরু হয়েছিল পুরুলিয়ায় রেখা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের হাত ধরে। এর পরে মুর্শিদাবাদ থেকে মেদিনীপুর, একের পর এক মেয়ে তাদের পথ ধরেছে। উত্তর ২৪ পরগনার খোলাপোতার মথুরাপুর গ্রামের বছর বারোর মেয়েটিও বাবা-মাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, এখনই সে পরের বাড়ি গিয়ে হেঁসেল ঠেলতে চায় না। বরং খোলাপোতা প্রাণকৃষ্ণ হালদার গার্লস হাইস্কুলে পড়া চালিয়ে যাবে, এই তার সাধ। সাইকেল গ্যারাজে কাজ করা বাবা মেয়ের কথায় কান দেননি। জোর করে পাশের ময়লানি গ্রামের যুবক সামসুর ওরফে ভোগের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটির কথায়, “ঈদের পরের দিন বাবা-মা আমায় বাদুড়িয়ায় নিয়ে গিয়ে জোর করে রেজিস্ট্রি বিয়ের কাগজে সই করায়। এর পর থেকে ছেলেটা প্রায়ই বাড়িতে আসত। বারণ করলেও শোনেনি। বাবা-মাকে বলেও কিছু হয়নি। উল্টে আমায় মারত। বাড়ি থেকে বেরোতে দিত না।”
মরিয়া হয়েই মেয়েটি ঠিক করে ফেলে, পুলিশের কাছে যাবে। শুক্রবার সকালে প্রাইভেট টিউশন পড়তে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে বসিরহাট থানায় গিয়ে হাজিরও হয় সে। কিন্তু ওইটুকু মেয়ে আর অত বড় থানা! কোথায়, কী ভাবে, কার কাছে নালিশ করতে হবে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারেনি। কী করবে বুঝতে না পেরে থানা চত্বরেই কয়েক জনকে সে বিষয়টি জানায়। কিন্তু কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। শেষে হতাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরে মেয়েটি।
কিন্তু যে ভাবেই হোক আইসি-র কানে ঘটনাটি পৌঁছেছিল। বাড়ি পৌঁছনোর খানিক পরেই মেয়েটি হঠাৎ শোনে, দরজার কাছে তার নাম ধরে কে ডাকছে! বেরিয়ে পুলিশ দেখে সে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে চেপে রাখা ক্ষোভ-দুঃখ। তার মা প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু পরে চাপের মুখে ভেঙে পড়েন। সামসুরের মা রঞ্জিতা বেওয়া শুধু স্বীকারই করেননি, তিনি রীতিমতো বিরক্ত। তাঁর কথায়, “আমরা খুব গরিব। স্বামীর মৃত্যুর পরে ছেলেমেয়ে নিয়ে পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। সংসারের এই অবস্থায় ছেলে বিয়ে করছে শুনে তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিই। পরে শুনি, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রয়েছে।”
স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান লক্ষ্মী বিশ্বাসের দাবি, “ঘটনাটা কেউ আমায় জানায়নি। আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” বসিরহাট ২-এর বিডিও ভাস্কর রায়ের বক্তব্য, “নাবালিকা বিয়ের রুখতে গ্রামে-গ্রামে প্রচার চালানো হয়েছিল। এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, নজর রাখা হবে।” মেয়েটি যে ক্লাসে পড়ে, তার ক্লাসটিচার দেবযানী বিশ্বাস বলেন, “পড়াশোনায় যে ও খুব ভাল তা নয়। তবে ওর এই প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত। ওর জন্য আমাদের গর্ব হচ্ছে।” |