তেলে-দুধে দিব্যি মিশ খায়। যদি না মানা হয় অর্থনীতির অঙ্ক।
বাজার যে পথে চলছে তার উল্টো দিকে হাঁটলে কী পরিণতি হয়, তার প্রমাণ রাজ্যের পরিবহণ এবং দুগ্ধ শিল্প।
বাজারের নিয়ম মেনেই গত কয়েক বছরে এই দুই শিল্পের কাঁচামালের খরচ বেড়েছে। অথচ, অর্থনীতির সহজ হিসেব মেনে সেই অনুযায়ী দুধের দাম বা যাত্রিভাড়া বাড়ায়নি রাজ্য সরকার। ফলে, দুই শিল্পেই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। সেই ক্ষতি সামাল দিতে এখন সরকার উল্টোপথে হাঁটছে। বাড়াচ্ছে
ভর্তুকির পরিমাণ।
গত কয়েক বছরে একাধিকবার বেড়েছে জ্বালানি থেকে পরিবহণ শিল্পের যন্ত্রাংশের দাম। এই ক্ষতি সামাল দিতে প্রয়োজন ছিল ভাড়া বাড়ানোর। কিন্তু রাজ্য সরকার ভাড়া বাড়াতে রাজি হয়নি। ফলে এমনিতেই বেহাল সরকারি-বেসরকারি পরিবহণ শিল্প ফের ধাক্কা খেয়েছে গত সপ্তাহে ডিজেলের দাম লিটারে ৫ টাকা বেড়ে যাওয়ায়। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ের মুখে গোটা পরিবহণ ব্যবস্থা। কিন্তু সরকার এখনও ভাড়া না-বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অটল।
পরিবহণ দফতরের হিসেব বলছে, শুধু মাইনে বাবদ রাজ্যের পাঁচটি পরিবহণ নিগমকে মাসে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। তার উপরে পেনশন, গ্র্যাচুইটি, যন্ত্রাংশ কেনা এবং অন্য মেরামতের খরচ মিলিয়ে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০ কোটিতে। পরিবহণের এক কর্তার কথায়, “ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৫ টাকা বাড়ায় ৫টি নিগম মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা। ভাড়া না-বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই ক্ষতি ভর্তুকি দিয়ে মেটাতে হবে সরকারকে। না হলে কর্মী-সঙ্কোচন বা বাস কমানোর রাস্তায় হাঁটতে হবে।” |
সরকারি পরিবহণ না হয় ভর্তুকি দিয়ে চলতে পারে, কিন্তু বেসরকারি পরিবহণের কী হবে? ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে সোমবার পথে নামেনি বহু বেসরকারি বাস। তার পর পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেছেন, “আমরা কাউন্টার খুলে দিচ্ছি। বাস চালাতে না পারলে মালিকেরা পারমিট ফিরিয়ে দিয়ে যান। দেখা যাক ২৩ হাজার পারমিট নেওয়ার জন্য ২৩ লক্ষ লোকের লাইন পড়ে কি না।” কিন্তু পরিবহণ দফতরের বড়-মেজ-ছোট সব ধরনের কর্তারই মতে, ভাড়া বাড়ানো ছাড়া বেসরকারি বাস পথে রাখার আর কোনও উপায়ই নেই।
পরিবহণের মতো উলটপুরাণ সরকারি দুগ্ধ শিল্পেও।
রাজ্যের সাড়ে তিন হাজার সমবায়ের প্রায় ৫ লক্ষ সদস্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে বিক্রি করেন সরকার-নিয়ন্ত্রিত ‘মিল্ক প্রোডিউসার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ বা এমপিসিএস-কে। সরকার এঁদের কাছ থেকে দুধ কেনে লিটারপিছু ১৭ টাকা দরে। এই দুধ পরিশোধন করে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে সেন্ট্রাল ডেয়ারি, মাদার ডেয়ারি, মেট্রো ডেয়ারির মতো সরকারি বা সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা।
সমবায়গুলি থেকে এমপিসিএস-এর চাহিদা দৈনিক অন্তত ৩ লক্ষ ৭০ হাজার লিটার দুধ। কিন্তু সেই দুধের জোগান ক্রমেই কমছে। বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ লিটার কম দুধ পাচ্ছে এমপিসিএস। কিন্তু কেন? দুগ্ধ কমিশনার উদয়শঙ্কর নন্দী বলেন, “লিটারপিছু ১৭ টাকা দরে দুধ বিক্রি করে বিক্রেতারা গরু-মোষের খাবারও ঠিকমতো কিনতে পারছেন না। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলি যে দামে বাজারে দুধ বিক্রি করে তা বাড়েনি। তাই ওঁদের বাড়তি দাম দিতে পারছি না।”
নিজের রাজ্যে দাম না পেয়ে দুধ-বিক্রেতারা এখন ঝুঁকেছেন অন্য রাজ্যের দিকে। অসমে দুধ-বিক্রেতারা দাম পান লিটারপিছু ২৫ টাকা করে। ওড়িশা, বিহার, গুজরাত, ওড়িশা, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশেও এই হার ২২ টাকা বা তার চেয়েও বেশি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওই সব রাজ্যে দুধ পাঠানোর ঝোঁক বাড়ছে। মুর্শিদাবাদের দুগ্ধ উৎপাদক ভাগীরথী সমবায় সমিতির ম্যানেজিং ডিরেক্টর নির্মলকুমার কর্মকার জানাচ্ছেন, “ট্যাঙ্কার করে দুধ চলে
যাচ্ছে ভিন রাজ্যে। তারা আমাদের চাষিদের দিচ্ছে লিটারপিছু ২০ টাকা।” রাজ্য সরকার দাম না-বাড়ালে সব
দুধই বাইরে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা।
সরকার কিন্তু দুধের দাম বাড়ানোর বদলে পরিবহণ শিল্পের মতোই ভর্তুকি বাড়ানোর রাস্তায় হাঁটছে। ঠিক হয়েছে, অন্য রাজ্যে দুধ-বিক্রি ঠেকাতে লিটারপিছু ১ টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার। কিন্তু তাতেও তো অন্য রাজ্যে যে দাম মেলে তার ধারেকাছে পৌঁছনো যাবে না। অতএব ভর্তুকির দাওয়াইতেও এ রাজ্যে দুধের জোগান বাড়বে না বলেই মনে করছেন প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের কর্তারা। |
তবে দুধ ভিন রাজ্যে পাঠানোর ঝক্কি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের কাছে মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিয়েছে বেসরকারি দুগ্ধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি। ‘আমুল’-এর কর্তা রঘু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “২০০৮-এর মে মাসে দু’টো গ্রাম থেকে আমরা দুধ নেওয়া শুরু করেছিলাম। এখন বর্ধমান ও হুগলির ৫৭টি গ্রামের গো-পালকদের কাছ থেকে পাচ্ছি দেড় লক্ষ লিটার। আগামী মার্চ মাসের শেষে এই দুই জেলার ৭৫টি গ্রাম থেকে পাব অন্তত দু’লক্ষ লিটার দুধ।” তাঁরা দুধ চাষিদের দাম দিচ্ছেন লিটার প্রতি ২১ থেকে ২৭ টাকা।
দুধ চাষিদের বেসরকারি সংস্থা বা ভিন রাজ্যে দুধ বেচার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস-ট্যাক্সি মালিকদের তো সেই উপায় নেই। তাই ভাড়া বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আর্জি জানিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। সেই আর্জিতে কান না-দিয়ে সরকারের একটা বিকল্প হিসেবে ট্যাক্সিতে বিজ্ঞাপন লাগিয়ে আয় বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ট্যাক্সি মালিকদের দাবি, “যে হারে ডিজেলের দাম বেড়েছে, তাতে আর ওই সব ফর্মুলা কাজ করছে না। এখন সরাসরি ভাড়া না-বাড়ালে গাড়ি চালানো যাবে না।” বেসরকারি বাস মালিকরাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভাড়া না-বাড়ালে রাস্তায় আর বাস নামানো যাবে না। মদন মিত্র কিন্তু সোমবার মহাকরণে ফের বলেছেন, “ভাড়া এখনও বাড়ানোর কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিগোষ্ঠী। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর আগে আমাদের রাজ্যবাসীর অবস্থাটাও ভাবতে হবে।” যদিও আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও এ দিনও মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক বসাতে পারেননি পরিবহণমন্ত্রী। কবে বসবে, তা-ও নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি। |