বছর খানেক আগেও নিজের দেড় বিঘা জমিতে বিপুল সব্জি ফলাতেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের পোলেরহাট-১ পঞ্চায়েত এলাকার আতিহার রহমান (নাম পরিবর্তিত)। মাস ছয়েক আগে তাঁর জমির উপর থেকে পাঁচ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। বর্ষার জলে ওই জমি এখন কার্যত পুকুর। চাষ-আবাদ লাটে উঠেছে।
একই ভাবে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কাশীপুর থানার টোনা মৌজার ধিপধিপে গ্রামের আর এক চাষির জমি থেকে। সেই জমিতেও চাষআবাদ শিকেয়।
ভাঙড় এলাকায় এ দু’টি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্রেফ মাটির লোভে বিঘের পর বিঘে কৃষিজমি লোপাট হয়ে যাচ্ছে এই এলাকা থেকে।
কেন কৃষিজমির মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন ভাঙড়ের চাষিরা? |
আতিহারদের কথায়, “জমি থেকে জোর করে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে নামমাত্র টাকা। ওদের মাটি কাটতে না দিলে আমাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। ভয়ে চুপ করে রয়েছি।”
ওরা কারা? কাদের ভয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন এলাকার চাষিরা?
স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য, চাষির জমি থেকে জোর করে মাটি কেটে নিচ্ছে সিন্ডিকেটের দল। অভিযোগ, ওই সব সিন্ডিকেটের মাথার উপরে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তার হাত। আর সেই সুবাদেই দিনের পর দিন দক্ষিণ এবং উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আতঙ্কের ছায়া তৈরি করেছে সিন্ডিকেটগুলি। অভিযোগ, এলাকার বেশ কিছু দুষ্কৃতীও ওই সব সিন্ডিকেটে ঢুকে পড়েছে। তারাই এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে।
কী রকম সেই আতঙ্ক?
এলাকার মানুষের অভিযোগ, মাটিবোঝাই লরির চাপে ফেটে গিয়েছিল বাড়ির জলের লাইন। সেই ঘটনার প্রতিবাদ করায় কাশীপুরের এক মহিলাকে মারধর করে মাটি ব্যবসায়ীরা। ঘটনাটি পুলিশকে জানানোর ‘অপরাধে’ পরের দিন ফের মারধর করা হয় আয়েষা বিবি নামের ওই মহিলাকে। অভিযোগ, এর পর আহত অবস্থায় তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় স্থানীয় একটি পুকুরের ধারে। এলাকার কেউ ওই মহিলার চিকিৎসা করলে তাঁরও একই অবস্থা হবে বলে হুমকি দিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। কলকাতায় কর্মস্থল থেকে তাঁর স্বামী না পৌঁছনো পর্যন্ত আহত অবস্থায় পুকুরধারের একটি ঝোপের ভিতরে পড়েছিলেন আয়েষা। ঘটনাটি পুলিশের খাতাতেও নথিভুক্ত করা হয়েছে। ক’দিন আগেই মাটি মাফিয়াদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে খুন হতে হয়েছে কাশীপুর এলাকার আজিজুল বৈদ্য নামের এক ব্যক্তিকে।
স্থানীয় এক কৃষকের কথায়, “মাটি দিতে রাজি না হলে মারধর তো জুটবেই, প্রাণে মেরেও ফেলতে পারে ওরা।” দুষ্কৃতীদের ভয়ে নিজেদের নামও প্রকাশ করতে রাজি নন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা।
কাশীপুর-ভাঙড়-রাজারহাট জুড়ে এমনই দৌরাত্ম্য মাটি মাফিয়াদের!
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রের খবর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় এলাকার ওড়িয়াপাড়া, টোনা, শ্যামনগর এবং উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া এলাকার চাষের জমি থেকে জোর করে মাটি কেটে আনা হচ্ছে। ভাঙড়-২ নম্বর ব্লকের উত্তর গাজিপুর, টোনা ও বকডোবা মৌজার প্রায় সাড়ে চারশো বিঘা জমিতে মাটি ফেলে ভরাটের কাজ করছে একাধিক সিন্ডিকেট। অভিযোগ, নিরীহ মানুষের উপর জুলুম করে মাটি তুলে তা বেচে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে সিন্ডেকেটের লোকেরা।
কিন্তু মাটি বেচে এত লাভ কী করে?
ভাঙড় এলাকার একটি সিন্ডিকেটের সদস্যেরা জানান, পুকুর-সমেত সাড়ে চারশো বিঘা জমি ভরাট করে উঁচু করতে প্রায় দেড় লক্ষ লরি মাটি ফেলতে হবে। এক লরি মাটির জন্য জমির মালিককে দেওয়া হয় সাড়ে তিনশো টাকা। গাড়ি ভাড়া আরও তিনশো টাকা। আর মাটি-ভর্তি লরি বিক্রি করা হয় ১৬০০ টাকায়। অর্থাৎ, এক লরি মাটিতে লাভ থাকে এক হাজার টাকা। সেই হিসেবে গোটা জমিটি ভরাট করতে পারলে অন্তত ১৫০ কোটি টাকা লাভ হবে বলে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যেরা জানিয়েছেন। তার পরে জমিটি প্লট ভাগ করে বা এক লপ্তে বড় কোনও সংস্থার কাছে বিক্রি করলে কম করে আরও প্রায় একশো কোটি টাকা লাভ থাকবে।
প্রশাসনের নাকের ডগাতে কী ভাবে এই মাফিয়া-রাজ চলছে?
পুলিশের একাংশের অভিযোগ, এই মাফিয়া-রাজে মদত রয়েছে তৃণমূলের নেতা এবং ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের। তাঁর ছত্রছায়ায় না থাকলে ওই এলাকায় সিন্ডিকেট-ব্যবসা চালানো অসম্ভব। অধিকাংশ সিন্ডিকেটের লোকই এখন আরাবুলের ছায়াসঙ্গী। এক পুলিশ অফিসার বলেন, “আরাবুলের বকলমে তাঁর ভাই আজিজুল ওরফে খুদে সিন্ডিকেট চালাচ্ছে। কয়েকশো বিঘা জমি ভরাটের বরাতও পেয়েছে সে।” তৃণমূলের স্থানীয় কয়েক জন নেতার দাবি, মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতেই ওই বরাত পেয়েছে খুদে। যদিও এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরাবুল। তিনি বলেন, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমার এবং ভাইয়ের কোনও যোগাযোগ নেই। কেউ কোনও অপকর্ম করলেই, আমার নাম জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা চক্রান্ত।”
ওই এলাকায় জমি মাফিয়াদের দাপট অবশ্য নতুন নয়। ২০০৯-এর অগস্টে রাজারহাটে স্থানীয় একটি ফুটবল প্রতিযোগিতা চলাকালীন দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন এক যুবক। ঘটনাস্থলের কাছেই ‘বেদিক ভিলেজ’-এ একটি সিন্ডিকেটের অফিস রয়েছে এবং সেখানে অস্ত্র রয়েছে, এই অভিযোগ তুলে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় ক্ষিপ্ত জনতা। তখনই জানা যায়, ওই এলাকায় জমির দখল ঘিরে দু’দল সিন্ডিকেটের মধ্যে লড়াইয়ের কথা। এবং তখনই ওই এলাকায় জমি মাফিয়াদের দাপট এবং সেই প্রসঙ্গে তৎকালীন বিধায়ক তথা তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের মদতের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। আরাবুলের ভাই আজিজুল তথা খুদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগও ওঠে। ‘বেদিক ভিলেজে’র ঘটনার তদন্তে স্পষ্ট হয়, ওই এলাকায় বিভিন্ন কৃষকের জমি কম দামে কিনে তা প্রোমোটারদের হাতে বিপুল দামে তুলে দিত কিছু দুষ্কৃতী। ওই দুষ্কৃতীরাই পরে জমি মাফিয়া হয়ে ওঠে। জমি কেনা-বেচা ঘিরে অল্প কয়েক দিনেই কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠে তারা।
অভিযোগ ওঠে, আরাবুল এবং খুদেই ওই এলাকায় জমি মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণ করে। ওই ঘটনায় আরাবুলের কয়েক জন সঙ্গী এবং ‘বেদিক ভিলেজ’-এর জনা কয়েক কর্তা গ্রেফতার হলেও খুদেকে ধরতে পারেনি পুুলিশ। পরে সে আদালতে আত্মসমর্পণ করে। ‘বেদিক ভিলেজ’ কাণ্ডের আগে যে জমিগুলি মাফিয়ারা বিক্রি করেছিল, সেগুলিই এখন মাটি ফেলে উঁচু করা হচ্ছে। সিন্ডিকেটের এক সদস্য জানান, ওই জমিগুলি ছিল নিচু চাষের জমি। এখন সেগুলি মাটি ফেলে রাস্তার উচ্চতায় আনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, যে সব সিন্ডিকেট ওই জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারাই এ বার মাটি ব্যবসায় নেমেছে। তা হলে কি এলাকার মানুষকে বাঁচাতে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেবে না? দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “আজিজুল খুন ও আয়েষা বিবিকে মারধরের ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মাটি কাটা নিয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ মিললে তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।” কিন্তু মাফিয়াদের ভয় কাটিয়ে সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে যেতে পারবেন কি? পুলিশ কি তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারবে? উত্তর মেলেনি পুলিশের কর্তাদের কাছেও। মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যের ব্যাপারে এলাকার নেতা হিসেবে কোনও প্রতিবাদ করেছিলেন কি না প্রশ্ন করা হলে আরাবুল বলেন, “ও সব দুষ্কৃতীর কাণ্ড। আমি ও সবের মধ্যে থাকি না। অভিযোগ অনুযায়ী পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।” |