|
|
|
|
এ রাজ্যেও ‘সম্মানরক্ষা’য় খুন |
মা বললেন মেরে ফেলো, বাবা কোপ মারলেন মেয়ের ঘাড়ে |
সুস্মিত হালদার ও সুদীপ ভট্টাচার্য • কৃষ্ণনগর |
|
‘...তা হলে মনে করব, তুমি মরে গিয়েছ।’
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে উত্তমকুমারের বহু সিনেমায় এই সংলাপ শোনা গিয়েছে কখনও ছবি বিশ্বাস, কখনও কমল মিত্রের মুখে। বাড়ির অমতে নায়ক বা নায়িকা বিয়ে করতে চলেছেন। তখনই রাশভারী বাবার এই চরম ঘোষণা।
|
ধৃত ছায়া ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র |
শ্মশান ঘোষ অবশ্য মুখে বলেই ক্ষান্ত হলেন না। ‘কাজে’ও করে দেখালেন। অভিযোগ, ধারালো অস্ত্রে কুপিয়ে খুন করলেন ১৭ বছরের মেয়ে মাম্পিকে। তিনি একা নন, সেই ‘কাজে’ সঙ্গে পেলেন ভাই এবং ছেলেকে। সব থেকে আশ্চর্যের, সামনে দাঁড়িয়ে মা ছায়াদেবী সমানে বলে গেলেন, “আমাদের পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। এ মেয়ের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। মেরে ফেলো ওকে।” ঘটনার ভয়াবহতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মায়ের এই মারমুখী চেহারা।
ঘটনাস্থল নদিয়ার নাকাশিপাড়া। শহর থেকে অনেক দূরে, প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও পরিবারের সম্মান রক্ষায় এমন খুনের ঘটনা এ রাজ্যে বিরল। বরং চট করে মনে পড়ে পঞ্জাব-হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশের কথা। মনে পড়ে ‘লাভ সেক্স অউর ধোঁকা’ সিনেমার সেই দৃশ্য, যেখানে বাড়ির অমতে বিয়ে করার জন্য শ্রুতিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কুপিয়ে খুন
করে তার বাপ-দাদার পাঠানো ভাড়াটে গুন্ডারা।
এখানে কিন্তু ভাড়াটে খুনি নয়, খোদ বাপ-দাদার হাতেই খুন হয়ে গেল মাম্পি। এবং সেটাও মায়ের তুমুল প্ররোচনায়। সোমবার ভোরে নাকাশিপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম কড়কড়িয়ার বাসিন্দাদের অনেকের চোখের সামনেই ঘটে গেল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা।
কী ঘটেছিল শ্মশান ঘোষের পরিবারে?
সম্পন্ন দুধ ব্যবসায়ী শ্মশানবাবুর দুই বিয়ে। প্রথম পক্ষের এক ছেলে। প্রথম স্ত্রী মারা গেলে বিয়ে করেন ছায়াদেবীকে। দ্বিতীয় পক্ষে দুই মেয়ে। বড়র বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট মাম্পি প্রেমে পড়ে পড়শি সঞ্জয় দে’র। রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে সঞ্জয়দের বাড়ি। দিনমজুরি করে কোনও মতে দিনগুজরান তাদের। গত এপ্রিলে সঞ্জয়কে বিয়ে করে বাড়ি থেকে পালায় মাম্পি। কিন্তু সে নাবালিকা। পুলিশে অভিযোগ জানালে মাম্পিকে অপহরণের দায়ে গ্রেফতার হয় সঞ্জয়। ৬৫ দিন জেল খেটে সদ্য বাড়ি ফিরেছে সে। |
|
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী |
মাম্পিকে তার বাবা-মা রেখেছিলেন পাশের গ্রাম ভেবোডাঙায় তার কাকার বাড়িতে। আজ ভোরে সেখান থেকে পালিয়ে সোজা নিজের গ্রামে এসে সঞ্জয়ের বাড়িতে ওঠে মাম্পি। সঞ্জয় সে সময় বাড়িতে ছিল না। তার মা মাম্পিকে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে প্রতিবেশীদের ডেকে আনেন। এর মধ্যে খবর পেয়ে সঞ্জয়দের উঠোনে হাজির শ্মশানবাবু, তাঁর ভাই মানিক, ছেলে বলরাম এবং স্ত্রী ছায়াদেবী। সকলে মিলে জোর করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মেয়ের কিন্তু একটাই কথা, “আমি যাব না। এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি এখানেই থাকব।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, মাম্পিকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তার কাকা। বাবা আর দাদার হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র। আর মা, ছায়াদেবী বলছিলেন, “পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে, ওকে মেরে ফেলো!” দাদার অস্ত্রের কোপে কাটা পড়ে মাম্পির ডান হাতের বুড়ো আঙুল। আর্ত চিৎকার করে ওঠে মাম্পি। পরিস্থিতি যে গুরুতর, তা বুঝেই গ্রামের কয়েক জন মাম্পির বাপ-দাদাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেন। লাভ হয়নি। অস্ত্র হাতে তাঁরা তেড়ে যান গ্রামের লোকেদের দিকে। বাধ্য হয়েই সরে যান গ্রামবাসীরা। মাম্পির ঘাড়ে তখন এলোপাথাড়ি কোপ মারছেন শ্মশানবাবু। গলাটা কোনও মতে ঝুলে রয়েছে তখন।
ঘটনাস্থলেই মারা যায় মাম্পি। খবর পেয়ে গ্রামে পুলিশ এলে বাবা-কাকা-দাদা পালিয়ে যান। ধরা পড়েন মা ছায়াদেবী। মনোবিদ থেকে সমাজকর্মী, কেউই চট করে রাজ্যে এমন খুনের ঘটনা মনে করতে পারলেন না। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করেন, এই ঘটনার পিছনে রয়েছে পারিবারিক সম্মান এবং ব্যক্তিগত রেষারেষি। তিনি বা সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ, কেউই এ রাজ্যে মেয়েকে খুনের পিছনে মায়ের এমন প্ররোচনার কথাও মনে করতে পারলেন না। সাধারণ ভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য, পারিবারিক বিবাদ এবং জাতপাতের বৈষম্য সম্পর্কের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। সেখানে মেয়েকে সরিয়ে দেওয়া, আটকে রেখে মারধর থেকে ছেলেকে খুনের হুমকি এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। আছে রিজওয়ানুর রহমানের মতো ঘটনাও, যেখানে মেয়ের পরিবার থেকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার হয়েছিল বলে রায় দিয়েছে আদালত। কিন্তু দিনের আলোয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে কুপিয়ে খুন? তা-ও মায়ের প্ররোচনায়? মনে পড়ল না ওঁদের।
|
ছ’মাসের বলি |
• অগস্টে অন্ধ্রের কুর্নুলে বাড়ির অমতে গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করায় মেয়ে-জামাইকে খুন করে পুঁতে দেয় বাবা-ভাই।
• তামিলনাড়ুর কাড্ডালোরে গত জুনে বাড়িতে না জানিয়ে প্রেমিককে বিয়ে করায় নিজের বোনকে খুন করে এক যুবক।
• হরিয়ানার কারনালে মে মাসে কিশোরী বোনের গোপন প্রণয়ের কথা জানতে পেরে তাকে ছুরি মেরে খুন করে দাদা।
• মে মাসেই অন্ধ্রের মুম্মিদিভরম মণ্ডলের পাশের গ্রামের যুবকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে মেয়েকে খুন করে বাবা।
• এপ্রিলে পটনায় বাড়ির অমতে বিয়ে করায় নিজে হাতে মেয়েকে শ্বাসরোধ করে খুন করে মা। |
|
সাম্প্রতিক সময়ে আরুষি-হত্যা সব থেকে চর্চিত ঘটনা, যেখানে অভিযোগের আঙুল উঠেছে বাবার সঙ্গে মায়ের দিকেও। কোনও এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের সমাজকর্মী আসমা জাহাঙ্গির শুনিয়েছিলেন ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা। তিনি একটি সংস্থা চালান, যেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে নির্যাতিতা মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয়। তাঁদের পুরুষ আত্মীয়েরা (বাপ-কাকা) এসে পাছে আবার না নির্যাতন করতে পারেন,
সে জন্য সংস্থার দরজা ওই
আত্মীয়দের জন্য বন্ধ রাখেন আসমারা। কিন্তু এক ঘটনায় চমকে গিয়েছেন তিনি। এক বার এক মা তাঁর মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং ভিতরে ঢুকে মেয়েকে গুলি করে খুন করেন।
বাড়ির অমতে বিয়ে করলে এই রাজ্যেও বাপ-কাকারা বলে থাকেন, ‘তা হলে মনে করব, তুমি মরে গিয়েছ।’ কিন্তু অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার সাহস হয় না চট করে। মনোবিদেরা বলছেন, আইনের ভয় এর পিছনে বড় কারণ।
এখানে রাস্তায় নেমে প্ররোচনা দিয়েছেন মা। শাশ্বতী বললেন, “এখানে তাঁর নিজের আত্মরক্ষার তাগিদও কাজ করছে বলে মনে করা যেতে পারে। কারণ, সন্তানের যে কোনও ‘দোষত্রুটি’র জন্য সব চেয়ে বেশি দোষী করা হয় মাকেই।”
এখানেও শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছেন মা ছায়াদেবীই। ঘটনার আকস্মিকতায় পালিয়ে যায় সঞ্জয়ের পরিবারও। রাতে অবশ্য তার মা-বাবা বাড়ি ফেরেন। সঞ্জয় রয়ে যান এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সঞ্জয়ের বাবা গৌরচন্দ্র দে বলেন, “আমার ছেলেকে জেল খাটিয়েছে। বারবার খুনের হুমকিও দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত মাম্পিকেই খুন করবে সেটা বুঝতে পারিনি।”
আর মাম্পি? বাবা-কাকাদের অস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে করতেও সে বলেছিল, “মরে যাব, তবু সঞ্জয়ের থেকে আলাদা থাকব না।” |
(সহ-প্রতিবেদন: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়) |
|
|
|
|
|