সম্প্রতি শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, জমি নিয়ে যাঁরা শিল্প করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেবেন।
এ দিকে জমি না নিয়েও কিন্তু এ রাজ্যে বহু শিল্প বেআইনি ভাবে
রমরমিয়ে চলছে।
যেমন পাথর খাদান। তার ব্যবস্থা কী হবে? লিখছেন
জয়া মিত্র |
নিজের প্রতিবেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে জীবনধারণের অধিকারই প্রাণিজগতের সবচেয়ে প্রাথমিক, প্রাকৃতিক অধিকার। স্মরণাতীত কাল থেকে এই একটিমাত্র অধিকারের ওপর নির্ভর করেই মানুষের সমাজ সহজ-শান্ত-সৃষ্টিশীল জীবনযাপন করে এসেছে। প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব রক্ষাও করেছে। সেই অধিকার থেকে চ্যুত হওয়াই হয়তো আজকের সামাজিক সংক্ষোভের অন্যতম প্রাথমিক কারণ।
অন্তত বীরভূমের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটছিল। ক্ষমতার হাতবদল বার বার হলেও ক্ষমতাশালীর লোভের দাপটে স্থানীয় মানুষের হাত থেকে স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার হৃত হয়ে চলেছে সেখানে। মাটির উপরের সম্পদের মালিকানা দখল হয়ে এলে হাত পড়েছে মাটির নীচে গচ্ছিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। বীরভূমের বিরাট এলাকা জুড়ে মাটির অল্প নীচেই ব্যাসল্ট পাথরের বিরাট ভাণ্ডার। গত শতকের শেষ পনেরো বছরে অন্য অনেক দেশের মতোই এই রাজ্যেও সবচেয়ে বড় ‘স্বনিযুক্তি-শিল্প’ নির্মাণ। প্রায় নিয়ন্ত্রণবিহীন এই ‘শিল্প’টি বিরাট বড় ধাক্কা দিল দেশের প্রাকৃতিক সম্পদভাণ্ডারে। ‘টপ সয়েল’ পুড়িয়ে তৈরি ইটভাটা, পুকুর কি জলাভূমি বুজিয়ে প্রকাণ্ড আবাসন, ধানখেত জুড়ে তৈরি কারখানা-বাড়ি, জলের গড়িয়ে যাবার স্বাভাবিক পথ বন্ধ করে হাইওয়ে আর এই প্রত্যেকটি নির্মাণেই দরকার, স্টোনচিপস।
যে কয়েক লক্ষ মানুষ ওখানে শান্তিপূর্ণ সামান্য দিনযাপন করেন, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বীরভূমের মাঠ-বন-খেত ধ্বংস করে তৈরি হতে লাগল শত শত পাথরখাদান। ইংরেজ আমলে রাজনগরে মহারাজ নন্দকুমারের খনির মতো হাতে গোনা দু’তিনটি খনি-খাদান বীরভূমে ছিল। |
সব আমাদের জন্য। রাজারহাট, কলকাতা। |
২০০০ সালের বন্যায় সারা পশ্চিমবঙ্গে পাকা রাস্তা ও নদী-সেতু যে ভাবে ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, তার মেরামতির জন্য স্টোনচিপসের চাহিদা অভাবিতপূর্ব ভাবে বাড়ে। তার পর থেকে সেই চাহিদা আর কমেনি। কাজেই কমবেশি পনেরো বছরের মধ্যে বীরভূমের নলহাটি-মুরারই-রামপুরহাট-মহম্মদবাজার-পাচামি-হিংলো, সমস্ত ভূমিরূপ বদলে গেল। সর্বত্র বিস্ফোরণে পাথর ফাটানো খাদ, পাশে উঁচু স্তূপ হয়ে থাকা মাটি, যার নীচে চাপা পড়েছে পাশের ধানজমি কিংবা স্থানীয় ছোট জলধারা, বিকট শব্দ করে চলছে অসংখ্য পাথরভাঙা কল। সাত × চব্বিশ ঘণ্টা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করছে পাথর বোঝাই অজস্র ট্রাক। এলাকায় ঢুকছে, ছড়িয়ে পড়ছে নানা স্বার্থের লোক। সোঁৎসাল-কাষ্ঠগড়া-হাবড়াপাহাড়ি-হরিণসিঙা জঙ্গল দূরস্থান, একটি বড় গাছ নেই, একটি পাখি নেই, কোনও রং নেই, সমস্ত এলাকায় উড়ন্ত পাথরগুঁড়োর ছাই রং ছাড়া। পাথর ফাটানোর জন্য জিলেটিন স্টিক বা ডিনামাইট দিয়ে যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যাতে থরথর করে গ্রামের অবশিষ্ট মাটির বাড়িগুলো, প্রায়ই তাতে ছিন্ন হয়ে যায় ভূগর্ভস্থ জলশিরা অ্যাকুইফার। সেই অমূল্য জল পাম্প করে মাঠে ঢেলে দেওয়া হয় পাথরগুঁড়ো সুদ্ধ। খাদানের মুখের কাছে তুলে রাখা কাঁকুরে পাথর সমেত মাটি বাতাসে বৃষ্টিতে ছড়িয়ে যায় আশপাশের খেতজমিতে।
প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হবার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল ওখানকার অধিকাংশ গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন। খাদান এলাকার গ্রামের একটা বড় জনসংখ্যা সাঁওতাল। নিজেদের প্রাকৃতিক প্রতিবেশকে সবচেয়ে সুন্দর ও কার্যকর ভাবে ব্যবহার করায় এই মানুষদের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু ক্রমশই এদের জমি চলে যাচ্ছে খাদানের গ্রাসে, গ্রামের পুকুর-কুয়ো শুকনো, জঙ্গল নেই, নিরুপায় দুর্দশায় এদের এক অংশ বাধ্য হন ওই সব খাদান কিংবা ক্রাশারেই কাজ করতে। পরবর্তী কালে, ২০১০ সালে বেআইনি খাদান-বিরোধী আন্দোলনে নেতাদের যখন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করেন, ‘খাদান ক্রাশার খারাপ ঠিকই, আইনও মানছে না। কিন্তু এগুলো যদি আমরা বন্ধ করে দিই, আদিবাসী ভাইয়েরা কী খাবেন?’ সেই আদিবাসী তরুণরা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘খাদান তো মোটে ত্রিশ বছরের, তার আগে কি আদিবাসীরা না খেয়ে থাকত?’
জীবিকা ও জীবনযাপনের প্রধান আধার প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার প্রতিরোধে গত পাঁচ বছর ধরে এ রাজ্যে নানান আন্দোলন গড়ে উঠছিল। সারা দেশে এমন আন্দোলনের বয়স আরও বেশি। এর মধ্যে দীর্ঘ দিনের আন্দোলনগুলির বৈশিষ্ট্য যে, এগুলো চলছিল স্থানিক ভাবে, স্থানীয় মানুষদের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে। বাইরে থেকে আসা নেতৃত্ব ছাড়াই। নন্দীগ্রাম-লালগড়ের আন্দোলন নাড়া দিচ্ছিল বীরভূমের আদিবাসীদের মনেও। ২০০৮-এ সিউড়িতে জন্ম নেয় বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা (আদিবাসী মঞ্চ) ও মাঝি পারগানা বাইসি (গ্রাম-প্রধানদের সভা)। সাঁওতাল আরিচালি (সংস্কৃতি), বার্ষিক খেলা, নাচগানের উৎসব, মেলা শুরু হয়। সাঁওতালি মাধ্যমে স্কুলশিক্ষা বিষয়ে কথা বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই ঘটল একটা ঘটনা।
২০১০ ফেব্রুয়ারিতে সন্ধ্যাবেলা তালবাঁধ গ্রামের এক খাদানে অসময়ে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে এক বিরাট বিস্ফোরণ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রামের ছ’টি বাড়ি। এই একদা-সম্পন্ন গ্রামটির চারপাশ থেকে পাথরখাদান এমন গ্রাস করে যে বাহান্নটি পরিবারের মধ্যে একুশটি পরিবার মাত্র অবশিষ্ট থাকে। ওই বিস্ফোরণ ও পরদিন সকালে বাইকবাহিনীর হ্যান্ডগ্রেনেড নিয়ে গ্রামে চড়াও হওয়ার ঘটনায় যেন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল।
পর দিন সকালে নিজেদের প্রাচীন প্রথার আশ্রয় নিয়ে তালবাঁধে সমবেত গাঁওতা সদস্যরা মাদলের ডাকে আধ ঘণ্টার মধ্যে আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে জড়ো করলেন কয়েক হাজার সাঁওতাল পুরুষ-মহিলাকে। এলাকার সমস্ত খাদান ও ক্রাশার বন্ধ করে দিলেন তাঁরা, যেগুলোতে তাঁরা নিজেরাও কাজ করতেন। শুরু হল আদিবাসী গাঁওতার জোর আন্দোলন।
এই আন্দোলনের চেহারা প্রথম থেকেই আমাদের কাছে কিছুটা অপরিচিত। আন্দোলনের শুরুর দিকে যখন ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদী কর্মীরা যোগাযোগ করে সহযোগিতার আশ্বাস দেন, গাঁওতা নিজস্ব ধরনে তা প্রত্যাখ্যান করে। প্রকাশ্য মিটিংয়েই তাঁদের নিজেদের ভাষায় বলা হয়, উপস্থিত লোকেদের মধ্যে ঝাড়খণ্ড থেকে আসা আমাদের কিছু বন্ধু আছেন, যাঁরা আমাদের সাহায্য করতে চান। তাঁদের ধন্যবাদ, কিন্তু এখানকার ব্যাপার আমরাই সামলে নেব। যদি তাঁরা আমাদের সাহায্য করতে চান, তা হলে বরং ঝাড়খণ্ডের পাথরখাদানগুলো বন্ধ করুন। আদিবাসীদের পুরনো সামাজিক প্রথা অনুযায়ী এঁদের সমস্ত কাজকর্মের সিদ্ধান্তই সকলে একসঙ্গে বসে নেওয়া হয়। গাঁওতার আন্দোলন এক দিকে যেমন বেআইনি খাদান-ক্রাশার বন্ধ করে কেবল মাত্র সরকারি আইন মান্য করা খাদানগুলো খোলা রাখার দাবি তুলছেন, অন্য দিকে একই গুরুত্ব দিয়ে এঁরা চাইছেন আদিবাসীদের অভ্যস্ত সুস্থায়ী জীবনের ধরন ফিরিয়ে আনতে ও আধুনিকতার সঙ্গে তাকে মেলাতে। সম্পূর্ণ বন ফেরানো সম্ভব না হলেও, গত দু’বছরে গ্রামে গ্রামে লাগানো হয়েছে শাল, মহুয়া, নিম। নতুন উজ্জ্বলতায় ফিরে আসছে অঞ্চলের পুরনো মেলাগুলি, জাতের সব পরব, গোবর্ধনমেলা, সহরাই, কারাম, বাহা। খাদানের কাছাকাছি চোলাই মদ ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ঠেক থাকত। কাঁচা পয়সা ও কঠিন ক্লান্তি নিয়ে মজুররা বেশির ভাগ দিন বাড়ি ফিরতেন মাতাল হয়ে, সংসার উচ্ছন্নে যেত। সেটা বন্ধ হয়েছে, মারধোর নেই। দু’ বছরের মধ্যে গ্রামের প্রায় চল্লিশ শতাংশ বাচ্চা স্কুলে যায়। বন্ধ খাদানের জলে, পুকুরে মাছ চাষ হয়। সে মাছ গ্রামেই বিক্রি হয়। পাম্প বন্ধ বলে কুয়োয় জল এসেছে। ত্রিশ বছর পর বাবুই পাখি বাসা বাঁধছে তালগাছে। ঝোপঝাড়ে ফিরছে নানান পাখি, খটাশ, বুনো খরগোশ, রঙিন মাকড়সা। ভাল বৃষ্টি হয়নি ২০১০ থেকে। তবু প্রচুর ভুট্টার চাষ হয়েছিল বলে খাবার কষ্ট পায়নি মানুষ। নিজেদের পোশাক পান্ছি-লুঙ্গি বুনবার জন্য তাঁত বসাবার কথা ভাবছে গাঁওতা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাস্থ্য বিভাগে উপস্থিত করেছে ক্রাশারের কারণে অসুস্থ নিউমোকোনোসিস রোগীদের কেস।
এই আন্দোলনের ফলে জানা গিয়েছে চমকপ্রদ সব তথ্য। ভারত সরকারের আইন অনুসারে যদিও আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসীদের সঙ্গে কেনাবেচা করা যায় না, তবু প্রায় সব ক’টি খাদানই আদিবাসীদের জমিতে। মালিকদের কাছে জমির মালিকানা, খাদান করার অনুমতি, পরিবেশ দফতরের অনুমতি, কোনও কিছুই নেই। এমনকী ধানজমি থেকে যে এগুলি পরিবর্তিত হয়েছে পাথরখাদানে, সেই তথ্যও নথিবদ্ধ নেই। সরকার কোনও রয়্যালটি পায় না। কত পাথর উঠত? কেবল পাচামি থেকে পঞ্চান্ন টন ও আঠাশ টন পাথর বোঝাই ট্রাক বেরোত ১২০০ থেকে ১৫০০টি, দৈনিক। গ্রামের গলার কাছে, বুকের ওপর বসানো সারি সারি ক্রাশারের ধুলো নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা নেই। আদিবাসী গাঁওতা আন্দোলন করছে এমন বিষয় নিয়ে, যা আসলে সরকারি দফতরের করার কথা।
সম্প্রতি রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, জমি নিয়ে যাঁরা শিল্প করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথা। জমি না নিয়েও যে-সব শিল্প রমরমিয়ে চলছে, সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনলে একটা বিরাট অঞ্চলের মানুষের আস্থা অর্জন করবেন রাজ্য সরকার। স্বাধীনতার প্রথম শর্ত তো সার্বভৌমত্ব। সর্বভূমির ওপর বসবাসের অধিকার, অনাহারে না থাকার, উচ্ছেদ না হবার অধিকারই আমাদের স্বাধীনতা। |