ভারতীয় অর্থনীতিতে একটি প্রচলিত অভিযোগ: মুম্বই যাহাই করুক, দিল্লি তাহার পার্শ্বে দাঁড়ায় না। এই দফায় ছবিটি ঘুরিয়া গিয়াছিল। গত সপ্তাহে দিল্লি তাহার দীর্ঘ শীতঘুম ত্যাগ করিয়া অবশেষে সংস্কারের পথে পা ফেলিল। গোটা দেশ যে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারের প্রতীক্ষায় ছিল, অবশেষে প্রধানমন্ত্রী তাহার রূপরেখাটি স্পষ্ট করিলেন। দেখিবার ছিল, মুম্বইয়ে দুব্বুরি সুব্বারাও সেই তালে পা মিলাইতে পারেন কি না। তাঁহার সমস্যাটি বিচিত্র: টাকার যথেষ্ট জোগান না থাকায় দেশে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখিতে হইলে সুদের হার কমাইবারও উপায় নাই। তাঁহার কৃতিত্ব, তিনি দিল্লির সংস্কারের হাওয়ায় নিজের পাল উড়াইতে দ্বিধা করেন নাই, এবং নিজের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখিয়াই কাজটি করিয়াছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ঘোষণা করিল, রেপো রেট আপাতত অপরিবর্তিত থাকিতেছে, কিন্তু ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো ০.২৫ শতাংশ কমিয়া ৪.৫ শতাংশ করা হইল। প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককেই তাহার আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নিকট গচ্ছিত রাখিতে হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় ইহার নামই ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো। এই হার কমিবার অর্থ, ব্যাঙ্কগুলির হাতে ধার দেওয়ার মতো টাকার পরিমাণ বাড়িল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাঙ্কগুলির হাতে ১৭,০০০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হইবে। অনুমান করা চলে, অতঃপর ঋণ পাওয়া সহজতর হইবে।
আপাতদৃষ্টিতে, সুদের হার কমাইয়াও এই কাজটি করা যাইত। বস্তুত, তাহাই দস্তুর। কিন্তু এখন পরিস্থিতির দাবি অন্য। মূল্যস্ফীতির রাক্ষস এখনও অনিয়ন্ত্রিত। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়াই স্বাভাবিক। এই অবস্থায় সুদের হার কমাইলে পরিস্থিতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইত। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ফের চড়িতেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার অতি নীচু। ডিজেল, এলপিজি-র দাম বাড়াইবার পরেও ভর্তুকির ভার নেহাত কম নহে। কেন্দ্রীয় সরকার বাজারে ফের ধার করিতে পারে। ফলে, সুদের হার কমাইবার বিপদ অনেক। তা ছাড়া, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দীর্ঘ দিন ধরিয়াই বলিতেছে যে মূল্যবৃদ্ধির হার না কমা পর্যন্ত সুদের হার কমাইবার প্রশ্ন নাই। কাজেই, সুদের হার কমাইবার সিদ্ধান্ত ব্যাঙ্কের ঘোষিত নীতির সহিত সঙ্গতিপূর্ণও হইত না। ব্যাঙ্কের হাতে যে সুযোগ ছিল, ব্যাঙ্ক তাহাকেই কাজে লাগাইয়াছে সি আর আর কমাইয়াছে। বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির হাতে এখন টাকার খুব অভাব নহে। বিনিয়োগ করিলে সুফল মিলিবেই, অভাব এই বিশ্বাসের। সরকার সংস্কারে আস্থা জ্ঞাপন করিয়া বাজারকে যে ভরসা দিয়াছিল, ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত তাহাকে আরও মজবুত করিল।
তবে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যেন তাহার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যটি বিস্মৃত না হয়। আজ হউক বা কাল, সুদের হার কমাইতে হইবে। যে কোনও উন্নত অর্থনীতিতে সুদের প্রকৃত হার কার্যত শূন্যের ধারেকাছে থাকে। সুদের উপর নির্ভরশীল জীবনযাত্রা অকল্পনীয়, কার্যত বিনা মূল্যে লগ্নির অর্থ জোগাড় করিতে পারা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। ভারতের বাস্তব মাথায় রাখিলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষে অনতিভবিষ্যতে এই অবস্থায় পৌঁছানো কঠিন। কিন্তু লক্ষ্যটি ভুলিবার নহে। দিল্লি বা মুম্বই, কাহারও পক্ষেই এই লক্ষ্যে একা পথ চলা সম্ভব হইবে না, পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যখন বহু বিলম্বে হইলেও সংস্কারের পথে হাঁটিতেই মনস্থ করিলেন, তখন ভর্তুকির বোঝা কমাইতে আন্তরিক হউন। মেদভার অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। |