|
|
|
|
|
|
|
একটাভয় কষ্ট লজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
রতুকাকা আমার কেমন কাকা ছিল, ঠিক জানি না। তবে লোকটা যে অন্য রকম, বেশ বুঝতে পারতুম সেই ছোট বয়সেই। কেতাদুরস্ত শার্ট আর স্লিম-কাট প্যান্টের সঙ্গে একটা জাঁকালো টাই, ছিমছাম চামড়ার ব্যাগ, পালিশ করা জুতো, মুখে চটরপটর আংরেজি, ফুরফুরে সুগন্ধীওলা লোকটা আমাদের বাড়িতে যে কোনও বিকেলে হাট করে খোলা দরজা দিয়ে দুমদাম ঢুকে পড়ত, খানিকটা ‘হরে মুরারে’ স্টাইলে। রান্নাঘরে মুখ বাড়িয়ে আমার মা’কে রুটি-তরকারির দরবার করেই বাড়ির সব ছোট-বড়’র সঙ্গে হইহই ডিব্বা খুলে বসত। আমার সঙ্গে লাল বেড়ালের গল্প, দিদির সঙ্গে টুকটুকি পুতুল, দাদাকে ম্যাজিক শেখানো, জেঠিমার বরাদ্দ উত্তমকুমার তো মা’কে দিতে হত হেমন্ত-র ফ্যান হওয়ার মাশুল।
এ হেন রতুকাকা বেশ কিছু কাল মিসিং। মা-জেঠিমা এক দিন খোঁজ নিতে গেল এবং মুখ গম্ভীর করে ফিরে এল। বড়রা কী সব আলোচনা করল। জ্যাঠা রেগে বলল, আদিখ্যেতা। বেশ সাত-আট মাস বাদে, তুতুপিসি, মানে রতুকাকার দিদির সঙ্গে রতুকাকা এল আমাদের বাড়িতে। চমকে উঠলাম। কোঁচকানো শার্ট আর পাজামা, চোখগুলো ক্লান্ত, মুখে অনেক দাড়ি। ম্লান হেসে বলল, ‘কী রে মামনি, কেমন আছিস?’
এর পর বছরে তিন-চার বার মাত্র আসত রতুকাকা, সব সময় তুতুপিসির সঙ্গে। মাঝে মাঝে খুব কথা বলত, যেগুলোর মানে বুঝতাম না। মাঝে মাঝে চোখ ঘোলাটে করে তাকিয়ে থাকত, সেটাও বুঝতাম না। জ্যাঠা কী সব ব্যবস্থা করলেন, এক্স-রে টেকনিশিয়ান কোর্স-এ রতুকাকা ভর্তি হল। এক দিন বাড়িতে খুব হাসাহাসি। জ্যাঠা এক্স-রে পড়ানোর সময় রতুকাকা নাকি বলেছে, ‘বড়দা, এ তো দেখছি ব্যাপারটা খানিকটা এয়ার কন্ডিশন মেশিনের মতো!’ দাদা বলল, হবে না? বড় কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিল তো! ফটরফটর!
রতুকাকা জ্যাঠার ক্লাস থেকে বরখাস্ত হল। তার পর আবার বেপাত্তা। বছর দুয়েক পর এক দিন স্কুল থেকে ফিরে আঁতকে উঠলাম। তুতুপিসির সঙ্গে ওটা কে বসে আছে? অসম্ভব নোংরা শার্ট, চিটচিটে পাজামা, গা দিয়ে গন্ধ বেরোচ্ছে, চোখ ঘোলাটে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে, পাজামার দড়ি লুটোচ্ছে মাটিতে। কী হয়েছে? কেন হয়েছে? কিছু বুঝলাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে সাহসও পেলাম না। জিজ্ঞেস করলে একটা চেনা লোক যদি হঠাৎ অচেনা হয়ে যায়? তুতুপিসি বলল, ‘দ্যাখো রতু কে এসেছে, তোমার মামনি।’ রতুকাকা পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘এই, তুমি অক্ষয়বাবু তো, আমায় মেলায় নিয়ে যাবে?’ রতুকাকার ঘাড় এক দিকে একটু বেঁকে গিয়েছে। সমানে মাথা নাড়াচ্ছে। বাথরুম পেলেও পাজামার দড়ি খুলতে দিচ্ছে না।
কিছু দিন পর শুনলাম রতুকাকা নাকি ঘর থেকে বেরোয় না, তার পর শুনলাম ঘর অন্ধকার করে রাখে, তার পর শুনলাম ঘরে আটকে রাখতে হয়, চান করে না, খায় না, চান করানো যায় না, খাওয়ানো যায় না। বড় হয়ে মা’র কাছে শুনেছিলাম, রতুকাকা যাকে ভালবাসত, সে অন্য কাউকে বিয়ে করে চলে গিয়েছিল। তাকেই যৌতুক বাবদ রতুকাকা দিয়েছিল তার স্বাভাবিক সত্তাটা। এর পর রতুকাকা আর এক বার কি দু’বার এসেছিল। আমি দেখতাম আর ভাবতাম, এ কি সেই সুগন্ধীওলা মানুষটা, যে এক দিন দরজা দিয়ে ঢোকার সময় ‘আরে দিওয়ানো, মুঝে পহচানো’ বলে আমার জেঠিমার সঙ্গে নেচেছিল? |
|
|
|
|
|