|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: কিরণমালা-র
|
ঈপ্সিতা হালদার |
তার পর চুড়িবালা লেনের জীবনযাপন শেষ। এ বার রাজার হাবেলিতে ঝন-ঝন চিকনাই। সিং-দরোজা খুলে ঢুকতেই বমকা উঠোন, তার পর রাজসভা। উপরে চাঁদোয়া। আরও উপরে তিনতলায় সরু রেলিংয়ের পিছনে সাদা-কালো চৌখুপি মেঝে, করিডর, শ্বেতপাথরের টুল, আসবাব, ঝরনা, ঢাকা খাঁচায় পাপিয়া বদরিকা।
কিরণমালা, বড়ে ভাইয়া আর বরুণের এখানে আসার কথা। রানি বাঁজা বলে নিয়ে আসা হয়েছে রাজার রাখওয়ালি ফুলওয়ালি মালিনীর তিন ছেলেমেয়েকে। সেও অবশ্য বকলমে কিরণমালারই গুণে। একদিন কিরণমালা ফুল দিতে এসেছে তো মন্ত্রীমশাই আর রাজা দু’জন স্ট্যাচু। এ তো বিলকুল মণি মালিনীর কপি! একটু স্নেহের উদয় হল, আর বিবাহ- বিছানার উল্টো প্রান্তে জন্মালেও রাজরক্ত তো! এমনিতে এত কষ্টের এই সব মহল সাতপ্রদেশ তুলো আখের খেত, শেষমেশ আঁটকুড়ো নাম কিনে সেজকাকার ষণ্ডামার্কা নাতিকে দিয়ে দিতে হবে কি না, ভেবে রাত্তিরে ঘুম হচ্ছিল না। ‘পর ওরা ফুলওয়ালির বেটা বনে গেছে, নহি? শাক পাত্তে গেন্দা কি লহু!’ ‘তো আপ মিলা দিজিয়েগা কুছ গরমি। শাহী মসালা বগেরা।’
তো অরুণ বরুণ সকালে রাজভোগ খেয়ে টিপ পরে রোজ রাজসভায় যায়। রাজাজির খাস লোক, আম লোক, আজে লোক, বাজে লোক, সব্বাই ধন্য-ধন্য করে। এ যেন রূপকথার লালকমল নীলকমল, বুদ্ধু ভুতুম। রাজসভা রম-রম গম-গম করে। আর সাতমহলা বাড়ির ভিতরে ঝর-ঝর থথ্থর। পাতাটি পড়লে শোনা যায়।
কিরণমালা এ-ঘরে যান ও-ঘরে যান। ন’ বাজে, দস বাজে, গারা বাজে। চানের সময় হয়ে যায়, কিন্তু ঠিক ক’টা বাজে বুঝতে পারেন না। চুড়িবালা গলিতে শব্দে শব্দে বেলা বাড়ত। কী করেন কী করেন কিরণমালা ঘরে ঘরে ঘোরেন ফেরেন, আলনায় কাপড়চোপড় হাত বোলান, রসুইঘরে উঁকি মারেন, মেওয়া গোনেন। যত্ত খুশি খাও, যত্ত খুশি ছড়াও। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
‘ইয়ে তুমহারা হ্যায় বেটি, সব কুছ।’ রাজাজি মাথায় হাত বোলান।
‘পর ইয়ে তো মুঝে লটারি লগতা হ্যায়, খুদ কা নহি।’
রাজামশাই তাজ্জব। ‘ইয়ে আজিব লড়কি কো সমঝাও কোই। ইয়ে আরুন...’, হাঁকেন।
তো, স্ফটিকের আয়না, পালকের জাজিম, চুমকি বসানো শিফন, এ সবের মধ্যে ঘোরাফেরা। ডান দিকে হাত বাড়াও, বাদাম পেস্তার শরবত, বাঁ দিকে চামরে ফশ-ফশ মসলিন বাতাস। ভারে ভারে ভাণ্ড ভরা দুষ্প্রাপ্য মধু, পারস্যের আনার। হাতিশাল ঘোড়াশাল। কিন্তু আপন কিছুই না, নিজের একার আড়াল কিছুই না। চুড়িবালা লেনের উনুনখানা মনে পড়ে। ফোড়ন ফুরিয়ে গেলে চায়ওয়ালা খোকনকে ডাকলেই ও ছুট লাগাত রাখহরি স্টোর্স-এ। বা পায়ে চটি গলিয়ে নিজেই, একছুটে। আর আহ্, সন্ধেবেলা এক পত্তন বৃষ্টির পর চিৎপুর ট্রামলাইন নিয়ন পড়ে চক-চক করত। ঘরে এসে ঘুমোতে চাইত কাজলি বেড়াল। একটু হেঁটে বাঁয়ে ঢুকে দুপাট্টাওয়ালি জানকি আর তার ব্লকপ্রিন্টওয়ালে মরদ। বরুণ মোবাইল ফোন কিনে আনার পর ওদের ফোন করত রবিবার বিকেলে। আর ছিল ছোটে। মসজিদ পেরিয়ে বাঁকেবিহারী দত্তা লেনে ওদের শান্টিং হত। ওরা গঙ্গার ধার ধরে ভোরবেলা কোথায় জানি চলে যেত। সেই সব গল্প শুনে মাঝরাতে কিরণমালার ঘুম ভেঙে যেত সহসা। ওর এই সবে ভয়টয় লাগত না কিছু। দাদা খাসির মাংস আনলে ছুরি দিয়ে পিস করে নিত।
রাতে খাওয়া শেষ হয়। সইস পালোয়ান কোতোয়াল ধুনি জ্বালিয়ে বসে। কিরণমালা গিয়ে বলে, গল্প বলো। বলো, ওই মহল্লার পিছন থেকে, অন্ধকার থেকে, বেরিয়ে আসছে ছোটে। চাকর-বাকরেরা ভীত হয়ে বসে থাকে, হাঁ করে তাকায় রাজকুমারীর দিকে। পরদিন বড়ে ভাইয়া অরুণ ডাকেন বোনকে। ‘বরুণ কো দেখ। কেমন তমিজ শিখে গেছে। কাল লক্কীকে তামাচা মারল কেমন, লক্কী কি ওর ছোট? মর্যাদায় খাটো, তাই।’
কিরণমালা ফ্যাল-ফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকে। ভ্রষ্ট ভূতের মতো উহার আঁচল খসিয়া যায়।
‘ইঁহা পর খুদ কা কুছ নহি হ্যায়।’ শুনে বড়ে ভাইয়া বজ্রাহতের মতো বসে থাকেন।
রাত্তিরে ঘুম ভেঙে যায় ওর। কিছুটা ভয়-ভয় সময়ের পর ডিব-ডিব ডিব-ডিব মালগাড়ি যায়। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী জানলার সিলে উঠে আসে।
‘হোই! কী করস কিরণ?’
‘এই আমি বাঁদীর বেটি বাঁদী। আর আমার সোনার খাটে গা আর রূপার খাটে পা। আর ওদিকে ছোটে ক্যানাল-পাড়ে প্যান্ডেল বাঁধছে।’
‘কী চাস?’
‘থলে নিয়ে বাজার করতে চাই।’
‘কিরণ, তর জামা, তর কেশ আলুথালু। ওই গরাদের ছায়া তর মুখে লম্বালম্বি স্ট্রাইপ কাইট্যা পড়ে।’
‘আমি খাই না ভাত। জানলা খুলে চুল ঝুলিয়ে দিতে চাই। রাজসভায় দৌড়ে গিয়ে কোমরে ঠুমকা মারতে চাই পিতাজির সামনে নষ্ট মেয়ের মতো। দুপাট্টা মাথায় তুলে হাতিশাল থেকে ঘোড়াশাল দেউড়িতে ধক-ধক করতে চাই কাঁচুলি।’
ব্যাঙ্গমী হাসে, ‘বেশ করবি। চিলেকোঠায় পাগলি মাগিদের মতো ঢং দেখাইয়া উদলা কইরা দিবি সতীদের ঢাকা দেওনের বন্দোবস্ত।’
ব্যাঙ্গমা বলে, ‘না। ওতে হয় কিরণ এই হাবেলির কুন একটা কুঠরিতে তালাবন্ধ থাকব নয়তো সসুরালে কয়েদ হব। এই দ্যাশে পাগলিদের কেউ পড়তে পারে না। দাঁড়া, ব্যবস্থা শুন আমার। ওই ত তর দুই ভাই, সরেস কার্তিক দুইটা। বড়টারে ধরায়ে দিতাসি মাইয়া-মানুষের নেশা আর ছুটটারে দেখায়ে দিতাসি র্যাসের মাঠ। রাজা তখন দুই কুলাঙ্গাররে ছাইরা তরে দিব রাজ্জপাট। তুই তহন শিকারে যা, ভ্রমণে যা, জলকেলি কর, আপনা মর্জি।’
কিরণ বলে, ‘অরুণ বরুণ যা করে, তা নিয়ে কী হবে আমার? বরং তোমরা আমাকে জানলা দিয়ে বের করে নিয়ে যাও এই রাজপুরী থেকে। পৌঁছে দাও চুড়িবালা গলিতে মায়ের কোঠায়।’ ২৭/২বি/৫ চিৎপুর লেনে ‘টেষ্টি ফাষ্ট ফুড সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হল এই।
|
|
|
|
|
|