|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
গত ২৩ এপ্রিল ‘তোমাকে চাই’ নামে আমার নিজের লেখা-সুর করা আধুনিক বাংলা গানের প্রথম অ্যালবামটি প্রকাশের কুড়িতম বার্ষিকী উদ্যাপন করলেন আমার উৎসাহী শ্রোতা ও বন্ধুরা। কুড়ি বছর অনেকটা সময়। কিন্তু যদি ১৯৬৭ সাল থেকে এই ২০১২ অবধি ভাবি? পঁয়তাল্লিশ বছর। ১৯৬৭ সালে আমি (আঠারো বছর বয়সে) আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে অডিশন দিয়ে বেতারে রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও নজরুলগীতি পরিবেশন করার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম। প্রথম দুটিতে পেয়েছিলাম এ, বি-হাই গ্রেড, আর তৃতীয়টিতে বি। অর্থাৎ এ, বি-হাই এবং বি এই সিঁড়িতে সবচেয়ে নীচের ধাপে। কিন্তু গানবাজনা শোনার ও মনে রাখার কোনও পরীক্ষা যদি কোথাও থাকে তা হলে পরীক্ষক আমায় এ গ্রেড না-দিয়ে পারবেন না। এই জীবনে আমি বোধহয় এই একটিই কাজ ঠিক মতো করতে পেরেছি গানবাজনা শোনা।
১৯৫৫ সালে, ছ’বছর বয়সে, কটক থেকে কলকাতা চলে আসার পর বেতারে বাংলা গান শোনা শুরু। সঙ্গে বাজনাও। আমার জীবনে গান আর বাজনা একই স্থানে। বাজনার স্থান হয়তো একটু ওপরে। অনেকেই মনে করেন চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশক আধুনিক বাংলা গানের উজ্জ্বল যুগ। চল্লিশের কথা বলতে পারব না, তবে নির্মোহ হয়ে ভেবে দেখলে বলতেই হয়, আধুনিক বাংলা গানের যে রমরমা পঞ্চাশের দশকে ছিল, ষাটের দশক থেকে তা কিন্তু কমতে থাকে। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। বাবা ছিলেন আকাশবাণীর কর্মচারী। তাঁর মুখে শুনেছিলাম, ওই বছর কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দিয়েছিল প্রতিদিন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের সময় বাড়াতে হবে। আশ্চর্য, পদাবলি কীর্তনের সময় কিন্তু কমতে থাকে ক্রমশ। অথচ পদাবলি কীর্তনেরই না বাংলার ধ্রুপদী সংগীতের আখ্যা পাওয়ার কথা ছিল? বাবার কাছে শোনা এক দিন তিনি আকাশবাণী ভবনে ঢুকতে গিয়ে দেখতে পেলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে দারোয়ানের টুলে বসে আছেন। ‘কেষ্টদা, আপনি এখানে?’ প্রণাম করে এই কথা শুধানোয় কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ‘কে, সুধীন? দ্যাখো ভাই, তোমরা খেয়ালের জন্য আধ ঘণ্টা পর্যন্ত দাও। পদাবলি কীতর্নের জন্য পনেরো মিনিট ছিল। এ বারে কন্ট্র্যাক্ট-এ দেখছি, পদাবলি কীর্তনের জন্য মাত্র দশ মিনিট। দশ মিনিটে কি ও জিনিস হয়? আমি তাই তোমাদের স্টেশন ডিরেক্টর সাহেবের কাছে দরবার করতে এসেছি, আর একটু বেশি সময়ের জন্য। পনেরো মিনিটেও যা হতে চায় না, সেটা দশ মিনিটে কী করে হবে, বলো?’
এই সব কথা বাবা আমায় বলতে শুরু করেন আকাশবাণী থেকে অবসর নেওয়ার পর। আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি। বাবা বলেছিলেন, ‘পদাবলি কীর্তনের জন্য উমেদারি করতে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো শিল্পী ও মানুষকে যেখানে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের দারোয়ানের টুলে বসে থাকতে হয়, সেখানে সংগীত হতে পারে না, থাকতে পারে না। আস্তে আস্তে বাংলার সংগীতের কী দশা হয় দেখতে পাবি।’
পাচ্ছি। তবে আজ নয়, সেই ষাটের দশক থেকেই। তখনই খেয়াল করতে শুরু করি, হিন্দি ছবির গানের সুর ধার করে আধুনিক বাংলা গান তৈরি ও রেকর্ড করা হচ্ছে। তেমনই, ‘লিম্বো-রক’ নামে একটি পাশ্চাত্যের যন্ত্রসংগীতের সুরেও শোনা গিয়েছিল ‘যদি না ভালবাসিতাম’। সুরটি মনোরম, ছন্দোময়, আধুনিক। সেই সুরে তালে ছন্দে ‘ভালবাসিতাম’, ‘গেঁথে আনিতাম’ ইত্যাদি শুনে আমার তখনই মনে হয়েছিল, সুরে-কথায় গরমিল। এই গরমিল নিয়ে আধুনিক বাংলা গানকে বড্ড বেশি দিন কাটাতে হয়েছে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝির পর থেকেই পাড়ার মাঠ-ফাংশনে হিন্দি ছবির গানের দাপট। কিছু গায়ক-গায়িকা অর্কেস্ট্রা নিয়ে মঞ্চে উঠতেন। প্রথমেই একটা রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে, তার পর প্রধানত হিন্দি গান গাইতেন। শুরুর গানটি রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের অবদান। তার পরের ধারাবাহিক হিন্দি গান, হিন্দি ছায়াছবির ক্রমর্ধমান জনপ্রিয়তা ও বাংলা আধুনিক গানের কোণঠাসা হতে শুরু করার পরিণাম।
বাংলা গানের রেকর্ডের বিক্রি কমতে থাকায় গ্রামোফোন কোম্পানি সম্ভবত বাংলার নবীন প্রজন্মকে ধরার জন্য, বাংলায় ‘পপ সং’ রেকর্ড করে বাজারে ছাড়ে। এ রকম দুটি গানের কথা আমার মনে আছে: ‘বুশি পল’একটি ‘কুচকুচে জাতে স্প্যানিয়াল’ কুকুরকে নিয়ে। অন্যটি: ‘মা আমায় বলেছে আমি নাকি বড় হয়েছি’। সম্ভবত রাণু মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া দুটি গান। দুটিই বেশ অভিনব ছিল। ভাষার দিক দিয়েও গানগুলি ছিল ক্রিয়াপদের চলিত রূপের পাশেই হঠাৎ সাধু রূপের বিরক্তিকর উপস্থিতি বর্জিত। সলিল চৌধুরীর দুর্দান্ত আধুনিক সুরেও আমরা বাধ্য হয়েছি ‘কী যে তোমারে কব/ নীরবে চাহিয়া রব’ ইত্যাদি শুনতে। এ ধরনের কব-রব-নাহি-চাহি থাকলে গানগুলিকে তাদের রচনাকালের নিরিখে সার্থক আধুনিক গান বলা যায় কি? কেন জানি না, বাংলা পপ সং লেবেল দিয়ে আধুনিক গান তার পর বেশি রেকর্ড হয়নি। তার কারণ কি এই যে, বিক্রি হয়নি ভাল? হিন্দুস্তানি রাগসংগীতে তালিম পাওয়া শ্রাবন্তী মজুমদারও বাংলা পপ সং গাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কেউ কেউ ভাববেন বাংলা পপ সং আবার কী? খানিকটা এই ভাবে বলা যায়: আধুনিক বাংলা গানের গায়কীতে যে বৈঠকি ভাব একটু হলেও থাকে, তাকে এড়িয়ে ষাটের দশকের ইংরিজি পপ সং-এর কায়দায় গলাটাকে ফেলা। রাণু বা শ্রাবন্তী কিন্তু তাই বলে বাংলা ভাষার উচ্চারণটা সাহেবি কায়দায় করার চেষ্টা করেননি। এই প্রবণতা এবং বাংলা কথাগুলোকে খানিকটা হিন্দির মতো করে বলার এক বিচিত্র অভিলাষ বরং নব্বইয়ের দশক থেকে কারও কারও মধ্যে দেখা গিয়েছে। রাণু ও শ্রাবন্তী তার পর আর বেশি গান রেকর্ড করেননি। সময় ও গানের বাজারটাও তখন অন্য রকম ছিল। অথচ তাঁদের দু’জনের কণ্ঠেই আলাদা একটা ধ্বনি, ঘনত্ব, গন্ধ ছিল, যা একান্ত তাঁদেরই। নব্বইয়ের দশকে মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠ যেমন। উপমহাদেশের বেশির ভাগ লোকপ্রিয় মহিলা-শিল্পীদের কণ্ঠ চিকন, বিশেষ করে পঞ্চাশের দশক থেকে। মৌসুমীর গলা, তা নয়। রাণু ও শ্রাবন্তীর গলাও ছিল অন্য আওয়াজের, চরিত্রের। স্মরণ করা যেতে পারে, এক কালে সুপ্রভা সরকার, সুপ্রীতি ঘোষ ও উৎপলা সেনের কণ্ঠ। উল্লেখযোগ্য রকম আলাদা। উৎপলা সেনের কণ্ঠে এমন এক ঘনত্ব ছিল, যা নিবিড় কামনার ব্যঞ্জনা আনে এবং সেই কারণেই তার বিশেষ আবেদন। তাঁর গলার স্বরে যে অনুচ্চ কামনার আভাস ছিল, সেটাই পেয়েছিলাম রাণু ও শ্রাবন্তীর গলায় ও গায়কীতে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই কণ্ঠ দু’টিকে বেশিদিন পেলাম না আমাদের সংগীতের বাজারে। আমার ধারণা, তাঁদের কণ্ঠ ও ব্যক্তিত্বের উপযুক্ত গান তৈরি হয়নি।
যে কোনও সমাজের লঘু সংগীত, ইংরিজিতে যাকে বলা হয় ‘পপুলার মিউজিক’ বা পপ, তা দিয়ে সমাজটাকে আংশিক হলেও চেনা যায়। সময়ের সঙ্গে এই জনপ্রিয় গানবাজনাও পালটায়। আধুনিক বাংলা গানের মধ্যে যেমন, ‘আর্ট সং’ ও ‘পপ’, দুইয়েরই বৈশিষ্ট্য আছে। এই বিষয়গুলি নিয়ে বাংলায় আজও তেমন আলোচনা জমে উঠল না। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পশ্চিমবাংলার পত্রপত্রিকায় সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র নিয়ে যত লেখা হয়েছে, গানবাজনা নিয়ে তার কানাকড়িও হয়নি। বাংলা ভাষায় সংগীত-সাহিত্য যে আজও গড়ে ওঠেনি তার মূল কারণ এটাই। সংগীতকে যে আমরা আজও মেধানির্ভর সৃষ্টিশীল কাজ হিসেবে না দেখে প্রায় সম্পূর্ণ আবেগনির্ভর বিনোদনের মাধ্যম মনে করি, এটা তারও কারণ। |
|
|
|
|
|