কলকাতার কাছেই একটি নতুন হাসপাতালের প্রাথমিক প্রস্তাব এবং পরিকল্পনা থেকে শেষ পর্যন্ত
তার হয়ে-ওঠার ইতিহাস কাছ থেকে দেখেছেন তিনি, সেই অভিজ্ঞতার কথাই লিখছেন
দেবেশ রায় |
বছর বারো-চোদ্দো আগের কথা। আমাদের এক বন্ধু তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন সন্ধেবেলায়। আরও কারা আসবেন। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কী কথা হবে। সন্ধেয় গিয়ে দেখি সেখানে কয়েক জন রয়েছেন। অনেকেই অপরিচিত। পরিচিত তখনকার শ্রমিক নেতা প্রফুল্ল চক্রবর্তী। আর যাঁরা, তাঁরা অনেকেই ডাক্তার। ইউরোপ ও আমেরিকার নানা জায়গায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চাকরি করেন। এই ডাক্তাররা এখানে একটা হাসপাতাল তৈরি করতে চান। প্রফুল্ল তাঁদের এখানকার পাণ্ডা। তাঁরই উদ্যোগে এই আড্ডা।
এক জন ডাক্তার, তাঁর নাম শুভাশিস মিত্র, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইংল্যান্ডের বড় একটা হাসপাতালে দশ বছরের বেশি কাজ করছেন। তিনি একটা কম্পিউটার স্লাইড দেখিয়ে দেখিয়ে ঘণ্টা দেড়েক যা বললেন, তাতে আমার অন্তত হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে যা কিছু সংরক্ষিত বা স্বয়ং গঠিত ধারণা তা ভেঙেচুরে খানখান। যেমন, তিনি বললেন, হাসপাতালের দেওয়াল আমাদের অফিস-কাছারির দেওয়ালের মতো ঝাঁ-চকচকে মোজাইক হলে ও মেঝে তদনুরূপ হলে সংক্রমণের ভয় বেশি থাকে। তিনি আরও বললেন, হাসপাতালের স্যানিটেশন মানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যদি সমাজে প্রচলিত অভ্যেসের চাইতে অন্য ধরনের হয়, তা হলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রোগী তাঁর নিজেরই বাড়িতে ও পাড়ায় সংক্রমণে বিপদে পড়েন। |
যেমন, ডাক্তার হিসেবে আমরা এক জন রোগীকে শুধু জানাতে পারি কোন কোন পরীক্ষা তাঁর দরকার। কোন কোন পরীক্ষা তিনি করবেন সে বিষয়ে রোগীর মত বা অমতের মর্যাদা ডাক্তারের চাইতে কোনও অংশে কম নয়। যেমন, ডাক্তারের রসায়ন বিজ্ঞানী নন। ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশন করতে পারেন মাত্র রাসায়নিক পরিপূরণের বিষয়টি। যেমন, কোন রোগীকে সোডিয়াম খেতে হবে, কোন রোগীকে হবে না। তিনি কী ভাবে সেটা খাবেন সেটা স্থির করার দায়িত্ব রোগী ও ফার্মাসিস্টের। যেমন, যে সব পরীক্ষা ও অপারেশন বা পুরনো অঙ্গ বদলে নতুন অঙ্গ বসানোর ব্যবস্থা এখন ভারতে প্রচলিত তাতে অত অত টাকা খরচ হওয়ার কোনও কারণ নেই।
শুভাশিস মিত্রের এই উপস্থাপনায় এক বারের জন্যেও তিনি কলকাতার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলি সম্পর্কে একটিও নিন্দার কথা বলেলনি। আমরা উসকোবার চেষ্টা করেছি। উনি বললেন, যদি কোনও প্রাইভেট কোম্পানি পুঁজি খাটিয়ে হাসপাতাল তৈরি করেন, তা হলে সেখানে কোম্পানি চালানোর নিয়মই তো চলা উচিত। যেমন, আমরা তো চাইতে পারি না যে আমরা সন্ন্যাসী হব কিন্তু স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আমাদের সংসারও বহাল থাকবে।
তখনই জানা গেল, ওঁরা কয়েক জন অনাবাসী বাঙালি ডাক্তার তাঁদের ওখানকার সব আয় দিয়ে এখানে একটা হাসপাতাল গড়বেন। সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। এখানে জমিও কেনা হয়েছে। কাছেই আরও একটা জমিতে ডাক্তাররা নিজেদের বাড়ি করে নেবেন। এখানে তাঁরা সহযোগী বন্ধুবান্ধব চাইছেন। সেই হাসপাতালটিই উলুবেড়িয়ায় ‘সঞ্জীবন হাসপাতাল’। |
আজ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় হাসপাতালটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। ইতিমধ্যে ১৫০-জন চিকিৎসক নিয়ে সাত মাস ধরে হাসপাতালটি কাজ করে যাচ্ছে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই উদ্যোগের সম্পর্ক অনেক দিনের। তিনি যখন প্রথম এম পি, তখন থেকেই এই রাজ্যের সাক্ষরতা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সূত্রেই তিনি এই কর্মপ্রয়াসকে সমর্থন দিয়েছেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি এটা উদ্বোধন করছেন এর চাইতে যোগ্যতর সংযোগ খুব কমই হতে পারে।
কেন?
আমার বয়স (এটুকু বলার অধিকার হয়তো আছে) এখন এতই বেশি যে আমাদের জীবনে বেশির ভাগ ছোট বা বড় প্রতিশ্রুতিই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে একটা প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। খুব ছোটখাটো সব কারণে কত উদ্যোগই যে আমাদের ফেঁসে গিয়েছে। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সেই আত্মসমীক্ষাই হয়তো আমাদের সত্তাপরিচয় আমরা আরম্ভ করি, কিন্তু শেষ করি না।
আবার এই ব্যর্থতাকে মেনে নিতেও মন চায় না। সেখানেও রবীন্দ্রনাথই ভরসা ‘চণ্ডালিকা’য় বলেছিলেন আত্মনিন্দা পাপ, আত্মহত্যার চাইতেও বড় অপরাধ।
সঞ্জীবন হাসপাতাল আমাদের সেই পাপমুক্তির একটা নিশানা হয়ে উঠল। আজ থেকে বছর পনেরো আগে কয়েক জন অনাবাসী বাঙালি ডাক্তার দেশে ফিরে আসার ব্রত নিয়েছিলেন। সেই ব্রত তাঁরা উদ্যাপন করলেন। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা তাঁদের অর্জিত অর্থ দান করেছেন ফেরত নেওয়ার শর্তমুক্ত দান।
আজ থেকে বছর পনেরো আগে এক আত্মনিবেদিত শ্রমিক নেতা এমন একটা হাসপাতাল নির্মাণকে শিল্প-অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনের আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।
আজ থেকে বছর পনেরো-বিশ আগে এক তরুণ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে একটা নতুন ধারণা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
আমাদের জয় হোক। |