|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অবনীন্দ্রনাথ অনেক রকম |
আশিস পাঠক |
পেন্টিংস অব অবনীন্দ্রনাথ টেগোর, আর শিবকুমার। প্রতিক্ষণ ও রিলায়েন্স, ৭০০০.০০ |
ছবি লেখেন ওবিন ঠাকুর।
লেখেন?
লেখা কথাটার মধ্যেই কেমন একটা সাহিত্য-সাহিত্য গন্ধ। বোধ হয় সে জন্যই অবনীন্দ্রনাথের ছবির সমালোচক মহলে এই প্রশ্নটা বার বার উঠেছে যে তাঁর ছবি কতটা সাহিত্যধর্মী, অলংকরণ-উন্মুখ, কতটা তা গল্প বলে। শতবর্ষেরও বেশি আগে শিল্প-সমালোচক রজার ফ্রাই নব্য ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কে ইলাস্ট্রেশন বা অলংকরণ-এর তুলনা টেনেছিলেন। তারও আগে অবনীন্দ্রনাথ কৃষ্ণলীলা সিরিজ, বেতাল পঞ্চবিংশতি সিরিজ, পদ্মাবতী সিরিজ, শাজাহানের মৃত্যু, ভারতমাতা এঁকে ফেলেছেন। অলংকরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, বধূ, বিম্ববতী, দ্বিজেন্দ্রনাথের স্বপ্নপ্রয়াণ, লিখেছেন শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী।
ছবি ‘লেখেন’ যে ওবিন ঠাকুর আর কথা ‘আঁকেন’ যে অবন ঠাকুর তাঁরা দুজনে পাশাপাশি চলেছেন মোটামুটি অর্ধশতকের সৃজনজীবনে। সেই চলনটা সমান্তরাল নয় কখনও, বরং অনেক ক্ষেত্রে কাটাকুটি খেলার মতো। এবং, একটু যদি মুক্তছন্দে চিন্তা করি তবে এই দুজনের একটা প্রতীকী মিলন বোধ হয় অবনীন্দ্রনাথের রেখাক্ষর বর্ণমালা-য়। তা হলে অবনীন্দ্রনাথ কোন অর্থে আধুনিক? প্রশ্নটা তাঁরাই তোলেন যাঁরা গল্পকথন-নির্ভর ন্যারেটিভ পেন্টিংকে শিল্পের আধুনিকতায় স্থান দিতে চান না। তুলনা নয়, নিছকই প্রসঙ্গত এইখানে রবীন্দ্রনাথের কথা এসে পড়ে। প্রায় সারা জীবন কথা লিখে জীবনের উপান্তে এসে তুলি ধরলেন যিনি তাঁর সেই অস্তগমনকালের ফসলে গল্প নেই, ‘বাক্যে ঘেরা সীমা’ তাকে দেওয়া যায় না।
অবনীন্দ্রনাথের আধুনিকতা-সন্ধানে শিবকুমারের একটি উড়ানবিন্দু এই প্রশ্নটি। আর একটি, অবনীন্দ্রনাথ কতটা, কত দূর পর্যন্ত পুনরুজ্জীবনবাদী, রিভাইভ্যালিস্ট? চিত্রকলায় জাতীয়তাবাদী সেই পুনর্জীবনসন্ধান তাঁকে কি দূরে রেখেছিল শিল্পের আধুনিকতা থেকে? রাখলে, কত দূরে?
এই দুটো জরুরি প্রশ্ন, তাঁর পূর্ববর্তী অবনীন্দ্র-সমালোচনার ভিত্তিতে, এ বইয়ের ভূমিকাতেই তুলেছেন লেখক। তার পরে ছ’টি অধ্যায়ে (দ্য বিগিনিংস অব কৃষ্ণ লীলা, ফ্রম ইন্ডিজেনাস আর্ট টু ইন্ডিভিজুয়াল স্টাইল, ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইরেভারেন্ট সেন্সিবিলিটি, ল্যান্ডস্কেপস অব ইন্টেরিওরিটি, পোর্ট্রেটস/ ক্যারেক্টার্স/ মাস্কস, অ্যারাবিয়ান নাইটস, লেট ওয়র্কস) তার উত্তর-সন্ধান। আর সেই সন্ধান-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পরতে পরতে খুলে গিয়েছে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের অন্তরলোক, তৈরি হয়েছে তাঁর এক অ-পূর্ব শিল্পীজীবনী।
জীবনীটি অ-পূর্ব, তার একটা কারণ এর লেখক কেবল সশ্রদ্ধ প্রণাম নয়, চিত্রবিবরণ নয়, ইতিহাসের পট মাথায় রেখে চিত্রবিচারের পথে হেঁটেছেন। আর একটা কারণ, অবনীন্দ্র-চিত্রের এত বড় সংগ্রহ এর আগে হয়নি। রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী-র কলা ভবন ও রবীন্দ্র ভবন, দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট, ভারতীয় সংগ্রহালয় এবং বহু ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে হাজারখানেক ছবি মুদ্রিত হয়েছে এখানে। বেশির ভাগই পূর্ণপৃষ্ঠা, রয়েছে তার অংশবিশেষের ডিটেলও। এবং, ভারতীয় চিত্রমুদ্রণের গুণগত মানের বিচারে প্রগতি অফসেটে মুদ্রিত এই বই গুটিকয়েক ব্যতিক্রমের তালিকাতেই স্থান পাবে। অবনীন্দ্রনাথের ছবির এই বৃহত্তম গ্রন্থ-সংগ্রহটির উপস্থাপনার সূচনায় শিবকুমার ঠিকই লিখেছেন, ‘অবনীন্দ্রনাথ টেগোর ইজ অ্যান আর্টিস্ট হু ইজ মোর টকড অ্যাবাউট দ্যান সিন। ইন দিস হি ইজ লাইক আ ক্ল্যাসিক দ্যাট ইজ লিটল রেড বাট ইজ আ পার্ট অব আওয়ার কালচারাল আনকনশাস।’ এ ক্ষেত্রে অবন ঠাকুরের অবস্থাটা অনেকটা তাঁর ‘রবিকা’র মতোই। বর্ষে বর্ষে দলে দলে রবিকথন চলে আমাদের, কিন্তু কতটুকুই বা রবীন্দ্রনাথ পড়েছি আমরা?
এমন মহাসংগ্রহের সাক্ষ্যে অবনীন্দ্রনাথকে গভীর ভাবে পড়লে, বুঝতে পারা যেত, অবনীন্দ্রনাথ কী এই প্রশ্নের উত্তর, অবনীন্দ্রনাথ অনেক রকম। জাতীয়তাবাদী, ভারতশিল্পে ষড়ঙ্গ-লেখক অবনীন্দ্রনাথ, শাহজাদপুর নিসর্গের শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ, বাগীশ্বরী বক্তৃতার কথক অবনীন্দ্রনাথ, প্যারটস ট্রেনিং-এর অলংকরণশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ, খুদ্দুর যাত্রার অবনীন্দ্রনাথ... ‘আধুনিকতা’কে যদি তাত্ত্বিক তোতাকাহিনির পাঠ না করে ফেলি তবে এই অনেক রকম আধুনিক অবনীন্দ্রনাথ চির-দর্শনীয় হয়ে ধরা থাকলেন এই সংগ্রহে। সেই অবন ঠাকুরের লেখা ছবি কিংবা আঁকা কথা যতটা বোঝবার জন্য, তার চেয়েও বেশি বাজবার জন্য। |
|
|
 |
|
|