আতঙ্কের কালো মেঘের আস্তরণ ভেদ করিয়া আশার আলোকচ্ছটা দেখা গিয়াছে বারাসতে। একের পর এক জঘন্য অপরাধ ঘটিবার জন্য যে বারাসত অপরাধের মুক্তক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত হইয়াছিল, সেখানে পুলিশ এলাকার মানুষের সহিত হাত মিলাইয়া অপরাধ দমন করিবার পরিকল্পনা লইয়াছে। স্কুলগুলিতে শিক্ষকদের সহিত আলোচনা করিতেছেন পুলিশকর্তারা, এলাকার ক্লাবগুলির সহিত কথা বলিয়াছেন। যে এলাকাগুলি সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল হিসাবে পরিচিত ছিল, সেই সকল ‘বিপজ্জনক’ এলাকায় জনগণের সহিত পা মিলাইয়া মিছিল করিয়াছেন পুলিশকর্তারা। তাঁহাদের উদ্দেশ্য, কোথায় কী ভাবে অপরাধ হইতেছে, কাহারা অপরাধ করিতেছে, তাহার বিশদ ধারণা তৈরি করা। এবং স্থানীয় মানুষদের নজরদারির সহিত পুলিশি কার্যসূচির সমন্বয় সাধন হইবে। এই প্রচেষ্টার মধ্যে কিছুটা অভিনবত্ব রহিয়াছে। পুলিশের সহিত স্থানীয় জনগণের দূরত্ব, এমনকী বৈরিতা যেখানে স্বাভাবিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে, সেখানে তাহাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করিয়া পুলিশকর্তারা সাহস এবং সদিচ্ছার পরিচয় দিয়াছেন। যখন নাগরিকরা পুলিশের অকর্মণ্যতায় ক্ষুব্ধ, সেই সময়ে তাহাদের সহযোগিতা প্রার্থনার জন্য যথেষ্ট সাহসিকতার প্রয়োজন। পুলিশ যে অপরাধীদের সঙ্গে জুড়িয়া নাই, মানুষের পাশেই রহিয়াছে, সেই বার্তা অপরাধীদের নিকট পৌঁছাইতেও মিছিল-বৈঠকের পরিচয় ছিল। সর্বোপরি, পুলিশকর্তারা এই জনসংযোগের প্রচেষ্টাকে নিজেদের শিক্ষার উপায় বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। বিপথগামী কিশোর-যুবকদের ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করিবার চাইতে তাহাদের সুপরামর্শ দিয়া যথাযথ পথে রাখিতে পারিলে লাভ হইবে বেশি, এই উপলব্ধি পুলিশকর্মীরা লাভ করিয়াছেন জনসংযোগের ফলেই।
অনেকেই হয়তো আশঙ্কা করিবেন, ইহা নেহাত ‘দেখনদারি’। এলাকায় কে অপরাধ করিতেছে, কোথায় করিতেছে, তাহা পুলিশ ভালই জানে। পুলিশ নিয়মিত তাহার কাজ করিলেই অপরাধ দমন হইতে পারে, তাহার জন্য স্থানীয় মানুষের সহিত মিছিল-বৈঠক নিষ্প্রয়োজন। কথাটি মিথ্যা নহে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যও ইহা নহে। পুলিশকে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করিতে হয়। পুলিশকর্মীদের নিজেদের সততা-সদিচ্ছা লইয়া প্রশ্ন তুলিলেই চলিবে না, দেখিতে হইবে পুলিশের স্বাধীনতা, তাহাদের কাজের মূল্যায়ন রীতি এবং পুরস্কার-শাস্তির পদ্ধতি। পরিকাঠামোর প্রশ্নটিও জরুরি বারাসতে বহু পূর্বে একটি থানা ভাঙিয়া তিনটি থানা করিবার প্রস্তাব করা হইয়াছিল, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য করা হয় নাই। প্রয়োজনীয় সংস্কার, পরিমার্জনা না করিয়া কেবল পুলিশকর্মীদের দুষিলে লাভ হইবে না। অন্য দিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পদ্ধতি লইয়াও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিতে হইবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে পুলিশ স্থানীয় মানুষের সহিত নিয়মিত বৈঠক করিয়া থাকে। নাগরিকরা কোন সমস্যাগুলিকে গুরুতর বলিয়া মনে করিতেছেন, পুলিশ তাহার খবর রাখে। আবার স্থানীয় বাসিন্দারা নজরদারির কাজও করেন। এই ব্যবস্থা চালু হইবার পর শিকাগোয় অপরাধ অনেক কমিয়াছে। তৎসহ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে স্থানীয় মানুষের আগ্রহ এবং অংশগ্রহণ বাড়িয়াছে। নাগরিকদের সহিত সুসম্পর্কই সকল সমস্যার সমাধান নহে, ইহা ঠিক। কিন্তু ইহাও সত্য যে, পুলিশ-নাগরিকের সুসম্পর্ক থাকিলে তাহার সুফল কেবল আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেই আবদ্ধ থাকিবে না, গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার নানা দিকে তাহার প্রভাব পড়িবে। অপরাধীর সম্মুখে অসহায়তা নাগরিকের অক্ষমতার সূচক, অপরাধের নিরসনে সক্রিয় ভূমিকা তাহার সক্ষমতা নির্দেশ করে। নাগরিকের ক্ষমতায়ন করিয়া বারাসতের পুলিশ গণতন্ত্রকেই সবল করিয়াছে। |