মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিবেন, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মনমোহন সিংহের সরকার দীর্ঘ নিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিয়াছে, এই মাত্র। শব্দ ঘোষিত সংস্কারের অন্য প্রসঙ্গগুলি ক্রমশ আলোচ্য। আপাতত কেবল রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের প্রস্তাবটি বিবেচনা করা যাক। বস্তুত এল পি জি’র বিপুল ভর্তুকি সরকারি নিদ্রার একটি উৎকট প্রতীক। তাহার কুফলেরও। বাস্তববোধ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ না করিলেই বোঝা যায়, এই জাতীয় পণ্যের দাম কৃত্রিম ভাবে চাপিয়া রাখা অসম্ভব। আজ হউক বা কাল, ক্রেতাকে বাজার দরেই এল পি জি কিনিতে হইবে। কথাটি ২০১২ সালে যেমন সত্য, ২০০৪ সালেও তেমনই সত্য ছিল। অতএব, জনস্বার্থের কথা ভাবিলে নেতাদের কর্তব্য ছিল এমন ভাবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা, যাহাতে কখনও এক ধাক্কায় অনেকখানি দাম না বাড়ে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার পর দাম বাজার দরের সহিত তুলনীয় হয়। ইহা শুধুমাত্র অর্থনীতির যুক্তি নহে, ইহা রাজনীতির কথাও বটে। প্রকৃত, ইতিবাচক রাজনীতি। কিন্তু ২০০৪-এ দেওয়াল এবং পিঠের মধ্যে ব্যবধান ছিল, ফলে নেতারা সস্তা জনমোহনের পথই বাছিয়াছিলেন। ২০১২-এ ভর্তুকির বোঝার চাপে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়াছে। এখন সরকার বাধ্য হইয়া যে পথে এক পা ফেলিল, তাহা রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথ। আশঙ্কা হয়, সরকার দুই পা পিছাইল বলিয়া।
২০০৪ সালের জুন মাসে, ইউ পি এ সরকার প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসিবার পর, এল পি জি-র সিলিন্ডারপ্রতি দাম ছিল ২৬০ টাকার কাছাকাছি। ২০১২ সালে সরকার স্থির করিয়াছে, এক সিলিন্ডারের দাম হইবে ৭৫০ টাকার কাছাকাছি, অর্থাৎ এক ধাপে ৩৫০ টাকা মূল্যবৃদ্ধি। জনরোষ স্বাভাবিক। বিরোধী দলগুলি সেই রোষ অপচয় করিবে না। শরিকরাও নহে। চাপে পড়িয়া সিদ্ধান্ত গিলিবার অভ্যাস এই সরকারের বিলক্ষণ আছে। ফলে, যে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে অতি জরুরি, তাহার ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। অথচ, সমাধান অতি সরল ছিল। ২০০৪-এ ক্ষমতায় আসিবার পর প্রতি মাসে যদি সরকার ১.১ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি করিত, তবে আজ প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ওই ৭৫০ টাকার কাছাকাছিই থাকিত। বৎসরে ১৪ শতাংশ হারে বাড়িলেও একই ফল হইত। কিন্তু হঠাৎ দাম দ্বিগুণ হইয়া যাইবার ধাক্কাটি মানুষের পকেটে লাগিত না। জনস্বার্থ রক্ষার এই প্রাথমিক কথাটি নেতারা শুধুমাত্র সাময়িক লাভের কথা ভাবিয়াই বিস্মৃত হইয়াছিলেন। ফলে, ২০০৯ সালের নির্বাচনের সময় গ্যাসের দাম যখন ৫০০ টাকার কাছাকাছি হওয়া বিধেয় ছিল, তখন দাম ছিল ২৮০ টাকা। নেতাদের লোভের ফল ভারতের রাজকোষ ভোগ করিতেছে। পরোক্ষ ভাবে, জনগণ। জনস্বার্থ আর জনমোহন কোনও অর্থেই হাত ধরিয়া চলে নাই। এই ভুল হইতে শাসক দল যে শিক্ষা লয় নাই, তাহা স্পষ্ট। নচেৎ, এখনও অসম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত করিবার কথা ভাবিত না। কেন প্রত্যেক গ্রাহককে বৎসরে ছয়টি সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়া হইবে, জনমোহন ব্যতীত তাহার কোনও উত্তর নাই। মধ্যবিত্তের সংসার খরচে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের কাজ নহে। আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম যে ভাবে উঠিবে-নামিবে, গ্যাসের দামও সেই ভাবে কমা-বাড়াই বাঞ্ছনীয়। এখনই এই সিদ্ধান্তটি করিবার প্রকৃষ্ট সময়। এর পর গুজরাত-আদি বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের পর্ব; তাহা মিটিতেই লোকসভা নির্বাচনের হাওয়া উঠিবে। তখন যে আর সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে না, তাহা গ্যাসের সিলিন্ডারগুলিও বোঝে। সরকার ভবিষ্যতের জন্য একটি বিপদের বীজ বাঁচাইয়া রাখিল। রাজনীতির বিষবৃক্ষের ফল হইতে দেশের নিস্তার নাই। |