|
|
|
|
সরকার আছে, অবশেষে বোঝালেন মনমোহন |
সংবাদসংস্থা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা |
দু’দশক পরে দ্বিতীয় অধ্যায়।
সেই ১৯৯১ সালে সংস্কারের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতীয় অর্থনীতির চালচিত্রটাই পাল্টে দিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। আজ আরও এক বার সেই সাহস দেখালেন তিনি। নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগ আর জনমোহিনী রাজনীতির পিছুটান ঝেড়ে ফেলে পর পর দু’দিনে পাঁচ-পাঁচটা এমন সিদ্ধান্ত নিলেন মনমোহন, অর্থনীতির বাস্তববোধই যার মূল চালিকাশক্তি। ’৯১-এর অর্থমন্ত্রীই যেন জেগে উঠলেন ২০১২-র প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে।
গত কাল ভর্তুকি ছেঁটেছিলেন ডিজেল ও রান্নার গ্যাসে। আর আজ বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দিলেন বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায়। আরও শিথিল করলেন বিমান পরিবহণ এবং টিভি সম্প্রচার ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির শর্ত। এক ধাক্কায় পূরণ করে দিলেন শিল্প মহল এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশের অনেক দিনের দাবি। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি সংস্থার বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্তও আজ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
মনমোহনের এহেন সিদ্ধান্তে বাম-বিজেপির মতো বিরোধী, শরিক তৃণমূল ক্ষুব্ধ। কংগ্রেস শিবিরে বিস্ময়ও কিছু কম নয়। সর্বত্রই প্রশ্ন, হঠাৎ এমন কী হল যে এতটা সাহসী হয়ে উঠলেন মনমোহন! প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, আর কোনও উপায় ছিল না। সব দিক বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে সরকার যে আছে, সেটাই বোঝা দায় হয়ে উঠছিল। সেই সুযোগে জলঘোলা হচ্ছিল একের পরে এক দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। যা ক্রমশই কোণঠাসা করে ফেলছিল সরকার ও শাসক দলকে। কংগ্রেস মহলের আশা, সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা এ বার দুর্নীতি-বিতর্ককে অনেকটাই পিছনে ফেলে দেবে।
|
বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে এই সব
পদক্ষেপ।
এই কঠিন
সময়ে কাজের জোগান বাড়াবে।
দেশের স্বার্থে
যে সব সিদ্ধান্ত
নিয়েছি, তাকে
সমর্থন করুন
এটাই আমার অনুরোধ।
মনমোহন সিংহ,
প্রধানমন্ত্রী
|
গরিব ও সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী
কোনও কিছুকেই
আমরা সমর্থন করতে পারি না।
লুঠ চলছে লুঠ। সিদ্ধান্ত
পুনর্বিবেচনা না করলে
কড়া পদক্ষেপ করতে প্রস্তুত আছি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,
মুখ্যমন্ত্রী |
|
বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় ৫১ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র, বিদেশি বিমান সংস্থাকে ভারতের বিমান সংস্থার ৪৯ শতাংশ শেয়ার কেনার অনুমতি এবং টিভি সম্প্রচার ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির পরিমাণ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত এ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে কাজের সুযোগ বাড়াবে বলে আশা করছেন মনমোহন। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, সেটা সত্যি হলে দেড় বছর পরে লোকসভা ভোটে লড়ার পুঁজি থাকবে। পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি কমানোর ফলে সরকারের যা সাশ্রয় হবে, সেই টাকা খাদ্য সুরক্ষার মতো আম-আদমির মন জয়ের প্রকল্পে ঢালা যেতে পারে। সেটাও ভোট-বাজারে ডিভিডেন্ড দেবে। আসলে কংগ্রেসের এটা মরিয়া লড়াই। মনমোহন নিজেও মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, “বড় ধরনের সংস্কারের সময় আসন্ন। যদি মরতে হয়, তা হলেও লড়াই করেই মরতে হবে।”
শরিক-সহযোগীদের চটিয়ে সরকার টিকবে কি না, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে সরকারে যাঁর আপত্তি সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। মমতার অভিযোগ, তিস্তার জলবণ্টনের মতো এ বারও তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি কেন্দ্র। রেলমন্ত্রী মুকুল রায় যখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুপস্থিত এবং সে কথা যখন প্রধানমন্ত্রীকে আগাম জানানো হয়েছে, তখন এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ায় মমতা ক্ষুব্ধ। তাঁর কথায়, “খুচরো ব্যবসা নিয়ে আমাদের বিরোধিতার কথা তো কারও অজানা নয়। তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারেই সে কথা বলা আছে। সেই ইস্তাহার তো আমার ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, খোদ কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের অসন্তোষের কথা জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। সনিয়াকে মমতা বলেছেন, সরকারকে দুর্বল করতে তিনি চান না। কিন্তু কেন্দ্রই তাঁকে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে যেতে বাধ্য করছে। বস্তুত, মঙ্গলবার তৃণমূল সংসদীয় দলের যে বৈঠক ডাকা হয়েছে, সেখানে ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে দলীয় মহলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মমতা। ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টেও তিনি লিখেছেন, “সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করলে কড়া পদক্ষেপ করতে প্রস্তুত আছি।” ‘বিরক্ত’ মমতা আরও লিখেছেন, “গরিব ও সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী কোনও কিছুকেই আমরা সমর্থন করতে
পারি না। লুঠ চলছে লুঠ।”
তবে শুধু তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকার যে পড়বে না, সেটা মমতা বিলক্ষণ জানেন। সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল মুলায়ম সিংহ যাদব কী করবেন। তাঁর সমাজবাদী পার্টির মুখপাত্ররা আজ সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মুলায়ম বা তাঁর ছেলে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব মুখ খোলেননি। অখিলেশ তো আবার কিছু দিন আগে প্রকাশ্যেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
মমতা অবশ্য বলছেন, তাঁর লড়াইটা তাঁরই। অন্য কোনও দলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জোট গড়ার কোনও চেষ্টা তিনি করছেন না।
মনমোহনের সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক পরিণতি কী হতে পারে তার হিসেবনিকেশ কংগ্রেস করেনি এমন নয়। তাদের অঙ্ক মমতা (এবং মুলায়মও) অবিলম্বে লোকসভা ভোট চাইলেও বাকি দলগুলি ততটা আগ্রহী নয়। ফলে সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই কংগ্রেস নেতাদের অভিমত। তবে একই সঙ্গে মমতার সঙ্গে বিচ্ছেদকে অবশ্যম্ভাবী বলে ধরে নিচ্ছেন না তাঁরা। মমতাকে
পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়নি তা বোঝাতে কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি, তিনি চাইলে নিজের রাজ্যে এই সিদ্ধান্ত চালু না-ও করতে পারেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আনন্দ শর্মার কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি যদি না চান তা হলে পশ্চিমবঙ্গে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির অনুমতি না-ই দিতে পারেন।” তবে বিষয়টি নিয়ে মমতার সঙ্গে তাঁর দু’বার কথা হয়েছে বলে আনন্দের দাবি।
ইউপিএ-র প্রথম জমানায় বামেরা যখন সহযোগী দল, তখন আর্থিক সংস্কারের বহু প্রস্তাব শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছিল কংগ্রেসকে। দ্বিতীয় দফায় তৃণমূল সরকারে আসার পরেও অবস্থা বদলায়নি। মমতা বামেদের থেকেও বড় বামপন্থী হয়ে সংস্কারের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর আপত্তিতেই ক’মাস আগে মন্ত্রিসভায় খুচরো ব্যবসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েও এত দিন তা স্থগিত রাখতে হল। রাজনীতির কারবারীদের মতে, মমতার এখন দু’টো লক্ষ্য। এক, কংগ্রেসের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। যাতে দুর্নীতির কলঙ্কের দাগ তাঁর গায়েও না লাগে। দুই, কেন্দ্র-বিরোধিতার যে পরিসরটা বামেরা নিতে চাইছে, সেটা দখল করা।
মমতার এই দ্বিতীয় লক্ষ্য বানচাল করতে ইতিমধ্যেই আসরে নেমেছে বামেরা। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের অভিযোগ, “আসলে এটা তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের গড়াপেটা খেলা। কারণ তৃণমূলের সমর্থনেই সরকার চলছে।” সিপিআই-এর রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদারও বলেছেন, “মমতা দায় এড়াতে পারেন না। তাঁকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।” নিজেদের আলাদা আন্দোলনের ছবিটা স্পষ্ট করতে দেশ জুড়ে এক দিনের ধর্মঘটের ডাক দিতে পারে সিপিএম। আপাতত অবশ্য শনিবার থেকেই তারা পথে নামছে। অফিস-কারখানার গেটে বিক্ষোভ দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চার বাম শ্রমিক সংগঠন। আর এ রাজ্যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বিরোধী
দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র।
রাজনৈতিক নেতারা বিরোধিতা করলেও শিল্পপতিরা কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি। স্পেনসার্স-এর কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েন্কার মতে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি বাজারের গুণমানকে বাড়িয়ে দেবে। চাষি থেকে ক্রেতা সবাই উপকৃত হবে বলে মনে করেন ভারতী এন্টারপ্রাইজের রজন ভারতী মিত্তল। আর সিআইআই-এর প্রেসিডেন্ট আদি গোদরেজের মন্তব্য, “আজকের প্রক্রিয়া ফের সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করল।”
|
বিশ সাল বাদ |
২০১২ |
|
বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি, পথ খুলল ওয়ালমার্টদের |
|
|
|
|
|
|
২৪ ঘণ্টা
আগেই
ভর্তুকি ছাঁটাই
ডিজেলে |
টিভি সম্প্রচার ব্যবসায়
৭৪% বিদেশি পুঁজি,
লাভ টাটা-স্কাইদের |
|
|
ভর্তুকির
গ্যাস সিলিন্ডারও
বছরে ছ’টা |
|
|
রুগ্ণ দেশি সংস্থা
বাঁচাতে ৪৯% বিদেশি
বিমান সংস্থার লগ্নি |
|
|
১৯৯১ |
• একচেটিয়া ও সীমাবদ্ধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বসীমা বিলোপ |
• আবশ্যিক লাইসেন্স ব্যবস্থা প্রত্যাহার |
• নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সীমা ৫১% |
• সরকারি সংস্থাগুলিতে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ |
• চিনি ও সারে ভর্তুকি হ্রাস |
|
|
|
|
|
|