|
|
|
|
পক্ষীরাজ ঘোড়া তার পক্ষীরানি ঘুড়ি |
বিশ্বকর্মা পুজো ঘুড়ির মাস্তানি। যারা ঘুড়ি নিয়ে কালচার করে, তারা জানে
মাথা তুলে বাঁচতে। উপরের দিকে তাকাতে। সুস্নাত চৌধুরী |
এ গল্পটা বরং সেই ছেলেটাকে নিয়ে, যে বয়স বারো কি তেরোর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ময়দানে। আর বিস্ময়ে তাকিয়েছিল আকাশের ক্যানভাসে। যেখানে তখন অসংখ্য রঙের ফোঁটা কেউ স্থির, কেউ সরে যাচ্ছে। না, তার হাতে সে দিন লাটাই ছিল না। ছিল সরু আর লম্বা একটা ডাল। ছোট্ট ছেলেটা তার হাতের অস্ত্র দিয়েই সে দিন নামিয়ে নিয়েছিল কে-জানে-কার কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ি। লেগে থাকা সুতোটাকেই সম্বল করেই শুরু হয়েছিল তার আকাশে ওড়া। সারা আকাশকে চ্যালেঞ্জ জানানো। সেই তার বড় হয়ে ওঠার শুরু।
খুব তাড়াতাড়ি সে শিখে নিয়েছিল ঠিকঠাক কল খাটানোর কৌশল। জেনে গিয়েছিল কোনটা পেটকাটি, কাকে বলে মুখপোড়া, রসগোল্লা বা মোমবাতি আসলে কী রকম, ভড়-ই বা ঠিক কী! শুনে ফেলেছিল কত রকম সুতোর কথা। স্পেকট্রা, ডেক্রন, ডিকট। তবু, এত সবের মধ্যেও ওকে টানত যা-হোক কিছু নিয়ে বাতাসে ভেসে থাকার মজা। আর একটু... আর একটু উপরে যদি শুধু ওঠা যায়। ঘুড়ি নিয়ে লড়াই তখন ওর ভালই লাগত না। পাড়া-কাঁপানো ‘ভোকাট্টা’ চিৎকারে বাচ্চা ছেলেটা হকচকিয়েই যেত। অশালীন লাগত। খানিক আগেও যে ‘ভোম্মারা’ বলে লাফিয়ে উঠেছে, সেই দুষ্টু লোকটার ঘুড়ি কেটে গেলেও ওর মন খারাপ হয়ে যেত। আসলে, সুতো ছিঁড়ে ভেসে যাওয়া ঘুড়ি দেখলে ওর মরে-যাওয়া বাবার কথা মনে পড়ত। ও চিনতই না হারবার্ট সরকারকে, যে শিশুকালে মৃতা মার অনতিদূরে শুয়ে ঢিলি প্যাঁচ দেখেছিল। ‘মেঘলা আকাশে অনেক ওপর দিয়ে কেটে যাওয়া একটা কালো বুলুম দেখে হারবার্টের প্রায় ভয় করেছিল। এত গম্ভীর শেষযাত্রা হারবার্ট আগে বা পরে কখনও দেখেনি।’ তবে, ও খুব চেষ্টা করত অজানা পথে পাড়ি দেওয়া সেই সব ঘুড়িগুলোকে হারিয়ে যাওয়ার আগে নিজের কাছে টেনে নিতে; তার পর আবার সুতো বেঁধে আকাশে তোল্লাই দিতে। এতেই ওর মন উৎসব-উৎসব হয়ে যেত!
আসল উৎসব সতেরোই সেপ্টেম্বর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরেই নিয়েছিল, পাঁজিতে নির্ঘাত লেখা আছে, বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানোই বিহিত। ঠিক তখনই নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছিল শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা বিশ্বকর্মার হাতে ঘুড়ি তুলে দেওয়ার থিয়োরি। বাবলুকাকুর গ্যারাজের হেল্পারদের কালিমাখা হাতে রেঞ্চ-প্লায়ার্স নয়, সতেরো তারিখ ববিন লাটাই তুলে নেওয়ার ব্যাখ্যা। আর একটু বড় হয়ে অবশ্য আরও অনেক কিছু ভেবে নিয়েছিল। সতেরোই সেপ্টেম্বর মানে সংক্রান্তি। যেমন মকর সংক্রান্তির দিন ঘুড়ির উৎসবে মাতেন গুজরাত বা বাংলাদেশের মানুষ। এ প্রশ্নও জেগেছিল মনে, এর মধ্যে কি কোথাও শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার ভাবনা কাজ করছে? ইন্দোনেশিয়ায় বিবিন ঘুড়ি, জানগান ঘুড়ি উড়িয়েই তো প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কৃষকরা। জাপানের হনসু-তে খরা কাটানোর জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ আছে। চিনের ড্রাগন ঘুড়িও প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজনে কামনায় ওড়ানো। মকর সংক্রান্তির ‘আউনি-বাউনি’ও তো ধান তোলারই অনুষ্ঠান। তা হলে ভাদ্র সংক্রান্তির মর্মই বা অন্য রকম হবে কেন? যে উৎসব জানান দিচ্ছে আশ্বিনের আগমনের, যে আশ্বিনে আসবেন মা দুর্গা স্বয়ং। অতএব? না, এ সব তত্ত্ব উড়িয়ে ও ফাইন্যালি ধরে ফেলেছিল খুব গরম নয়, খুব ঠান্ডা নয়, আকাশে মেঘ নেই, কড়া রোদও নেই স্রেফ সে কারণেই সতেরোই সেপ্টেম্বর ঘুড়ি ওড়ানোর উপযুক্ত তিথি!
বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে ঘুড়িকেই ওর প্রেমিকা মনে হয়েছিল। রূপসী, তন্বী, নিখুঁত ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স। কখনও তিরতির কাঁপছে, কখনও স্থির। তত দিনে ও শুনে ফেলেছে রফি আর লতার কণ্ঠে ‘চলি চলি রে পতং মেরি চলি রে... সারি দুনিয়া ইয়ে দেখ দেখ জলি রে... ’ স্বপ্ন দেখত, ও চেপেছে পক্ষীরাজ ঘোড়ায়, আর সঙ্গে পক্ষীরানি ঘুড়ি। ওর মনে তখন বাজত হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে...
ঘুড়ি নিয়ে যারা কালচার করে, তারা জানে মাথা তুলে বাঁচতে। উপরের দিকে তাকাতে। সাহস করে ও-ও এক দিন উঠে গিয়েছিল একতলা বাড়ির ছোট্ট ছাদে। বাড়তে গিয়ে বুঝেছিল, চার পাশে বড্ড দেওয়াল। ওর আকাশ আসলে অন্যের জানলা মাত্র। তিনতলা-চারতলা-সাততলা বাড়িরা যেন ওর প্রেমিকাকে গডজিলার মতো গিলে ফেলবে। সে দিনই ও সিদ্ধান্ত নেয়, আরও উপরে উঠতে গেলে আরও উপরে তাকাতে হবে। অগত্যা ওকে শিখতেই হল মাঞ্জা। মায়দানি, বেরিলি, ডাবল স্পেশাল, সারস। তত দিনে ও বুঝে গিয়েছিল, কাটাকুটি না করলে বেঁচে থাকা যাবে না। ওর ঘুড়িকে কেউ উপরে উঠতেই দেবে না। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। শুধু নন্দিনীর বাড়িতেই নয়, দুনিয়ার সর্বত্রই ‘ঢিল দে ঢিল দে দে রে ভাইয়া’ বলে উঠতে না পারলে সমীরদের ব্যর্থ হতেই হবে। হাম ঢিল দে চুকে সনম!
আজ নতুন ফ্ল্যাটের ছাদে উঠেই বুঝতে পারছে, এখানে পৌঁছতেই পারবে না কোনও কানকাটা, ময়ূরপঙ্খী। আসবে না সেই পক্ষীরাজও। এত দিন পর পিনুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। স্কুলের বন্ধু। বাবার টেলারিং-এর দোকান থেকে সুতো চুরি করে আনত। ঘুড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে। হলদে চাঁদিয়ালের হলুদ সুতো, লাল মুখপোড়ার জন্য লাল। কিন্তু, ও সুতোয় কি ঘুড়ি টেকে আকাশে! পারেনি পিনু। ওরও আজ নিজেকে বড্ড পারফেক্ট লাগছে। সব মিলে যাচ্ছে। লাটাই, সুতো, মাঞ্জা এ সব কি বড় বেখাপ্পা ওর কাফলিঙ্ক লাগানো হাতে? এ বার কি দিনভর www.gamesgames.com কিংবা www.thekidzpage.com-এ ঢুকে ফ্লাইং কাইটস খেলবে তবে!
না কি, এক বার নীচে নেমে দেখবে? সূর্য ডোবার আগে পক্ষীরানিও তো ফিরে এসেছিল। ও-ও ফিরে যাবে ময়দানে। মাঞ্জা নয়, একদম সাদা সুতোর মতো দিনটা কাটাবে। আকাশটা রঙে রঙে ছেয়ে দেবে। |
ছবি এঁকেছেন সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|