|
|
|
|
ভাদ্রে রান্না, আশ্বিনে খাওয়া |
ভাদ্র সংক্রান্তির রাত্রে সবাই মিলে সারা রাত কুটনো, বাটনা, রান্না। পর দিন মা মনসাকে
নিবেদন করে খাওয়া। রান্নাপুজো। এবং অরন্ধন। মন্দার মুখোপাধ্যায় |
শ্রাবণ-ভাদ্র মাসটাই বাপ-বেটির মাস। চৈত্রসন্ন্যাসী-চড়ক নীলের উপোসে গেলেন তো শ্রাবণসন্ন্যাসী এলেন বাঁক-কাঁধে মাসভর জল ঢালতে। আর এই এত এত জল ঢালায়, নদী-নালা-পুকুরে যেমন কলকল করে জল উপচে এল, তেমনি খলবল করে বাইতে লাগলেন ‘তাঁরা’ সন্ধেবেলা যাঁদের লতা বলে। তাঁদের তো বাসায়, গর্তে, কোটরে জল, অতএব আস্তানা ছেড়ে কখনও উনুনের ভেতর, কখনও ধানের গোলায়, নয়তো চাল বেয়ে, আশেপাশে খোঁদলের খোঁজে। এই নাগনাগিনীর দলই গেরস্থের বাড়িতে, মা মনসার জ্যান্ত রূপ। শিবকন্যা সরস্বতী-লক্ষ্মীর মতোই এঁরও আদর কম নয়। পূর্ববঙ্গে মাসভর ভাসানের গান আর পশ্চিমবঙ্গে ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসা পুজো। এ-দেশিদের কারও ঘরে আবার ধান্যলক্ষ্মীর চার বারের পুজোয়, এক বার অর্থাৎ ভাদ্র মাসে লক্ষ্মী-মনসার একসঙ্গে আরাধনা। আলপনায় কমল, গাছ-কৌটো, প্যাঁচা, ধানের গোলার সঙ্গেই বিশেষ উপস্থিতিতে সাপ। আর এরই বোধহয় পল্লি-রূপটি হল রান্নাপুজো। না, খাস ঘটিবাড়ির গোটাসেদ্ধ-র সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা চলবে না, যা পঞ্চমীতে রেঁধে শীতলষষ্ঠীতে খাওয়া হয়, সরস্বতী পুজোর পর দিন। কারণ, রান্নাপুজো মানে রান্না পুজো এবং না-রান্নাও। অরন্ধন।
বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন ভাদ্র সংক্রান্তিতে সাধারণত অমাবস্যার অন্ধকারই থাকে। সেই ঘোর অন্ধকারে বাড়ির সবাইকে জুটিয়ে সারা রাত ধরে কুটনো, বাটনা, রান্না। আর পর দিন মা মনসাকে নিবেদন করে তবে খাওয়া। লোকে বলে, ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়া। এর পর যা কিছু উৎসব সবই হবে মহালয়ার পর থেকে, সুপর্বে। যে জন্য দেবী দুর্গার অন্যতম নাম ‘সুপর্বা’। |
|
তো, এই রান্নাপুজোর কুলুজি ঘাঁটতে বসে মনে পড়ছে, ছোটবেলায় ন্যুব্জ বৃদ্ধা কেষ্টর মা আঁচলচাপা দিয়ে, ছোট্ট কাঁসার বাটি করে, একটু পান্তাভাত, কচুর শাক আর ডালবড়া এনে আমার বাবার হাতে দিয়ে বলত: ‘রশোক (অশোক) দাদাবাবু তোমার জন্যি ‘আন্না’পুজোর পোসাদ এনিচি।’ উচ্চারণ নিয়ে আমরা খুব হাসতাম। কিন্তু অনেক ভাবে জীবনচর্যায় পরিবর্তন এলেও এই ‘আন্না’পুজো শব্দটা বেশ জাঁকিয়েই বসেছে। এখন অবশ্য ‘আন্নাপুজো’ শুনলেই জাঁকিয়ে ধরে ভয়। কারণ, ওই দিন শুধু বাড়িতেই নয়, চাকরিস্থলেও পরিচারিকাস্থানীয় মেয়েরা প্রায় সকলেই ছুটি নেবে, অন্তত দু’দিন। আমার বাড়িতে পরিচারিকা কবিতা আগে থেকেই বলে রাখে। আর বিভোর হয়ে বলতে শুরু করে রান্নাপুজোয় তাদের বিভিন্ন আয়োজনের কথা। ছোলা-নারকেল দিয়ে কালো কচুর শাক এবং একই সঙ্গে আরও এক পদ ইলিশের মাথা দিয়ে। নানা রকম সব্জি ভাজা, বিশেষত গাঁটি কচু, শোলা কচু আর চিংড়ি-ইলিশ থাকতেই হবে। খেসারির ডাল বেটে শুকনো ঝুরি, চুনোচানা মাছের পুঁইশাক চচ্চড়ি। বলতে থাকে যে, এই সব কুটনোবাটনা চলতে চলতেই তারা আশপাশ থেকে ফোঁস-ফোঁস, হিস্-হিস্ও শুনতে পায়। সরে-নড়ে চলে যান তাঁরা। বাস্তুসাপ বেরোবে জেনেই সিঁদুর ফেলে রাখা হয় উনুনের পাড়ে, গোয়ালঘরে। সধবা নাগিনীটির ফণাতেই নাকি সিঁদুরের ফোঁটাটি দেখা যায়। সব রান্নার পর শেষরাতে ভাত বসে, মাটির হাঁড়িতে। ফ্যান ফেলে, যখন জল ঢালা হয়, তখন নাকি তারার আলো নিভিয়ে সূর্যকে জায়গা করে দিতে থাকে চাঁদ। মেয়ে-বউরা উষারম্ভের আগেই স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে মায়ের থানে ভোগ দিয়ে আসে। কবিতার সংসারে ‘থান’ মানে বাড়ির পাশে ‘ময়দা কালীমন্দির’-এর পুকুর, যেখানে মনসার ঘটপুজো হয়।
আয়া সেন্টার থেকে আসা নমিতাদের রান্না পুজো, কিছুটা পাঁচমেশালি। দীর্ঘদিন শহরবাসী তারা। নমিতার মা ‘গ্যাস উনুনেই’ সব রান্না করেন, ভাতটুকু মাটির হাঁড়িতে আঁচ-আগুনে।
তবে তাঁরও তো সেই রাত জাগা, মেয়ে-বউদের সঙ্গে নিয়ে। ওদের উঠোনে মনসার থান আছে। তুলসী মঞ্চের মতোই, কাঁটামনসার ঝাড়ের মঞ্চ। আগে সেখানে দাঁড়াস সাপ আসত, রান্নাপুজোর রাতে এখন সব বাঁধানো কংক্রিট হয়ে যাওয়ায় তারা নাকি পালিয়ে গেছে ‘পিছন পানের’ পোড়ো জায়গায়। নমিতার মা বিশেষ আগ্রহে এই দিন মালপোয়াও ভাজেন। |
|
সবচেয়ে ভাল লাগল, আউটসোর্সিং থেকে আসা আমার কর্মস্থলে, পার্বতী-মায়া-ঝর্না এদের সঙ্গে কথা বলে। সকলেই কসবা ছাড়িয়ে, রুবি ছাড়িয়ে কোথাও একটা থাকে, যেখানে এখনও মানকচুর বন, গাঁটি কচুর ঝাড় এবং অঢেল কচুর শাক। এমনকী এর-ওর দাওয়ায় বেশ কিছু নারকেল গাছও। ওদের বেশির ভাগেরই স্বামীদের একাধিক বিয়ে, এমনকী বাবাটি মায়ের ঘরে থাকলেও, মায়ের একটি বা দু’টি সতীনও আছে। দুর্ভাগ্যতাড়িত হয়ে দল বেঁধে কাজে বেরিয়েছে। পোশাকে শাড়ি ছেড়েছে, ঘড়িতে সময় মেপেছে টাকা আর কাজের মূল্যে, তবু ‘আন্নাপুজো’ ছাড়েনি। পার্বতীই গুছিয়ে বলল, এই পুজোর নাম ‘রান্না’ আর ‘পান্না’। ‘পান্না’ মানে পান্তাভাত। ভাদ্রের জল হাঁড়িতে পড়লে সারা শ্রাবণ বৃষ্টি হবে, তবে তো আশ্বিনের ঢাক আর পাকা ধানের খেত। দেখেন না, এই সময় রোদ-বৃষ্টি একসঙ্গে, তাই তো শেয়াল-কুকুরের বিয়ে হয়। গরম ভাতে তাই জল ঢেলে পান্তা। বলল, সবার অবশ্য সব নেই। কারও বাড়ি ‘বিশেষ ভাজা’, কারও বাড়ি ‘ডাল শুকনো’, কারও বাড়ি ‘চিংড়ি-উচ্ছে’, এই রকম। তবে পান্তা আর কচুর শাক হবেই হবে। মাকে ইলিশ-চিংড়িও দিতেই হবে। এ সময় দুধকলা দিয়ে ভোগ দিলে চলবে না, সধবা মায়ের ভোগ তো! তার ওপর নাগনাগিনীরা যেহেতু জলাজঙ্গলে বেশি ‘বায়’, তাই কচুর রকমারি থাকবেই। পার্বতীর মা বিশেষ ভাবে বানান ঘেঁটকুল কচুর পাতা বেটে, কাঁচা সরষের তেল, নারকেল সরষেবাটা দিয়ে মাখা। এর সঙ্গে থাকে সরষে দিয়ে কচুর লতি এবং শাপলাডাঁটার ডালও। বলতে বলতেই তার চোখ দু’টি বিভোর হয়ে আসছিল, মনে ভেসে আসছিল সেই কবেকার ছবি। তার শিশুকালে, যখন সের-সের পান্তা আর ডালবড়া, মায়ের প্রসাদ হিসেবে খাল-বিল-নদী বেয়ে ঘাটে এসে লাগত। কাড়াকাড়ি পড়ে যেত সেটুকুর ভাগ পেতে। সেই সব পান্তার হাঁড়ির নীচে, নৌকোর ছই-গলুইতেও নাকি দেখা যেত সিঁদুরের ফোঁটা পরা ‘মা জননীকে’। বলছিল, ওদের রীতি হল, পাঁচফণার মাটির সরা কিনে ‘বাওন’ (ওরা পুরুত বলে না) ডেকে পুজো করানো, আর ভোগটি বেড়ে দিতে হবে পদ্মপাতায়। বললাম, পদ্মপাতা পাওয়া যায়? বলল, ওই এক দিন বাজারে ওঠে। সরা আর পদ্মপাতা কিনে এনে গোবরছড়া দেওয়া শুদ্ধ জায়গায় রাখে। স্নান করে কাপড় ছেড়ে রান্নার জোগাড়ে বসে, উনুন পুজো করে। রান্না সেরে আবার স্নান, আবার কাচা কাপড়। তার পর পদ্মপাতায় ভোগ সাজিয়ে, কোমরজলে নেমে, পুকুর, বিল বা নদীতে ভাসানো। বাড়ি ফিরে দেখা যাবে ঠিক কোনও একটা খাবার ঠোকরানো। মা জননী প্রসাদ করে গেছেন।
ভাবছিলাম অনেক কিছু। চোখে ভেসে উঠছিল, ভরা বর্ষায় ফুলহীন পদ্মদিঘি বড় বড় পাতায় জোড়া, যার জল দেখা যায় না। ভাবছিলাম, এই রান্নাপুজোর গল্প, যা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং বনগাঁ অঞ্চলে থাকা মেয়েগুলির কাছে পেলাম, সে তো সুন্দরবন ও বাংলাদেশের সঙ্গে যেন কোথায় মিলেমিশে গেছে। এই ‘ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়া’র রীতি কি একই ভাবে চূর্ণী নদীর পাড় ধরে ফুলিয়া, আনুলিয়া, রানাঘাট, শিবনিবাসেও? অজয়-কাঁসাই-শিলাই পারের বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর-বীরভূম-পুরুলিয়ার মেয়েরাও কি এই ‘রান্না-পান্না’ মানে? ভাবছিলাম জলজ বাংলার সাপ কিলবিল মোহময় রূপ ও স্বাদের কথা। ভাবছিলাম অমাবস্যার অন্ধকারে সাপের হিস্হিসানি শোনার প্রতীক্ষায় সাহসী মেয়েগুলির কথা। ভাবছিলাম নৌকো করে পাড়ায় পাড়ায় ‘আন্না-পান্না’ ভোগ বিতরণের কথাও।
কী করে ওরা পারে, এই রহস্য-রোমাঞ্চ-চাঁদের মা বুড়ির গল্প বলা জীবনকে প্রাণভোমরার মতো ছোট্ট কৌটোয় মুড়ে শহরের জীবনে ঘড়ি ধরে ‘অ্যারাইভাল-ডিপারচার’-এ নিজেদের মানিয়ে নিতে! যে মেয়েরা জানে পদ্মপাতায় বেড়ে দিয়ে ভোগ সাজাতে পঞ্চব্যঞ্জনে, তারাই তো সারি সারি টয়লেটের একপাশে বসে ছোট্ট কৌটো থেকে বার করে কোনও রকমে আলুসেদ্ধ-ভাত খেয়ে আবার দৌড়তে থাকে। অন্ধকার আর সাপের ছোবলকে যারা ভয় না পেয়ে, সারা রাত ধরে উৎসব সাজায় সংসারে, তারা আর শহুরে মানুষের আক্রমক হিংসায় কী ভয় পাবে! রান্নাপুজোর ছুটি তাই এখন বোধহয় শহুরে যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে, অন্তত এক দিনের প্রতীকী প্রতিবাদ এক অলিখিত ‘মাস ক্যাজুয়াল লিভ’ আর এর ফলেই শঙ্খলাগা ভালবাসার প্রজনন। |
ছবি এঁকেছেন সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|