বেরা উৎসবে ফিরল নবাবি আমল
ঠাৎ যেন সময় ফিরে গেল নবাবি আমলে। আলোয় সেজে উঠল হাজারদুয়ারি চত্বর। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আলোর রোশনাইয়ে কৃষ্ণপক্ষের আকাশ আলোয় ঝলমল করে ওঠে, তেমনি আতশবাজি থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোর মালা জলে পড়ে ভাগীরথীকেও রঙিন করে তুলেছিল। কিন্তু প্রায় তিনশো বছরেরও প্রাচীন এই আলোর উৎসব জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর সীমানা ছুঁতে পারল না কেন? বেরা উৎসব পর্যটন শিল্পের কোনও উন্নয়ন ঘটাতে পারল না কেন?

প্রশাসনের আয়োজন
জুডিসিয়াল দফতরের অধীনে থাকা মুর্শিদাবাদ এস্টেট ম্যানেজার অমিতাভ ভট্টাচার্য বলেন, “বেরা উৎসব পালনের জন্য সরকারের তরফে এ বছর ২ লক্ষ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা দেওয়া হয়েছে।” তবে গত দু’বছর থেকে উৎসবে আসা অতিথিদের বসার জায়গার বদল হয়েছে। আগে ওয়াসিফ মঞ্জিল প্রাসাদের দোতলার বারান্দায় অতিথিদের বসার বন্দোবস্ত করা হত। কিন্তু ওয়াসিফ মঞ্জিল এখন তালা বন্দি অবস্থায় পড়ে। অমিতাভবাবু বলেন, “এ জন্য ভাগীরথীর পূর্ব পাড় লাগোয়া তোপ ঘাটের কাছেই পাড় বরাবর চাতালে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে উৎসবে আগত অতিথিদের বসার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এর ফলে তাঁরা খুব কাছ থেকে বেরা ভাসান উৎসব উপভোগ করতে পারবেন।”
এদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ওই উৎসব চলে। সন্ধ্যা থেকেই হাজারদুয়ারি ও ওয়াসিফ মঞ্জিল চত্বরে মানুষের ভিড় জমতে থাকে। বেরা উৎসবে কলাগাছকে পর পর সাজিয়ে বিরাট ভেলা তৈরি করা হয়। বর্তমানে ওই ভেলার দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট বাই ৫০ ফুট। আগে এর তিন গুন বড় হত। ভেলার উপরে বাঁশ ও বাখারির সাহায্যে রঙিন কাগজ, অভ্র, রাংতায় মোড়া ছাতা-তোরণ তৈরি করা হয় তার চূড়ায় লাগানো হয় নিশান ও আলোর ঝালর। ভেলার গোটাটাই সাজানো হয় মোমবাতি দিয়ে। তবে ভেলাটাই সব নয়, বাঁশ ও বাখারির কাঠামোতে বিভিন্ন রঙের কাগজ, রাংতা দিয়ে ময়ুরপঙ্খী, হাতি, ঘোড়া, কুমিরের মুখের আকৃতি দেওয়া হয় নৌকার।
আগামী ১১ অক্টোবর জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। তবে নির্বাচনী কমিশনের বিধি-নিষেধের আওতায় পড়ে এ বারের বেরা উৎসবে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বড় ইমামবাড়া থেকে হাজারদুয়ারির বড় গেট পেরিয়ে ত্রিপোলিয়া গেট, চক গেট, দক্ষিণ দরওয়াজা হয়ে ওই নৌকার শোভাযাত্রা ওয়াসিফ মঞ্জিল প্রাসাদ ছুঁয়ে তোপ ঘাট চত্বরে পৌঁছায়। সেখানে কলার ভেলা দিয়ে তৈরি বজরাতে মালা দেওয়ার পরে সোনার ১টি ও রুপোর ৫টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। অতীতে তোপঘাটে কামান দেগে শুরু হত বজরা যাত্রা। এখন আতসবাজি পোড়ানো হয়। ওড়ে ফানুস। তার আগে নবাব বংশের প্রতিনিধি হিসেবে সৈয়দ রেজা আলি মির্জা এসে খেজেরের উদ্দেশ্যে হালুয়া, সুজির সিন্নি, দুটি পান ও একটি সুপারি ভাগীরথীর জলে উৎসর্গ করেন। চিরাচরিত প্রথা মেনে বেরা ভেসে যাওয়ার সঙ্গেই আশপাশ থেকে আরও অনেক নৌকা ভেসে যায়। ইতিহাস গবেষক তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রামপ্রসাদ পাল বলেন, “বেরা পারসি শব্দ, অর্থমহৎ উদ্দেশ্যে নৌপথে যাত্রা অর্থাৎ বড় নৌকার সঙ্গে অনেক ছোট নৌকা নিয়ে আড়ম্বর সহকারে যাত্রা করাকেই বলা হয় বেরা।”

উৎসবের ইতিহাস
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৭০৪ সালে বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবেদার হিসেবে মুর্শিদকুলি খান মুর্শিদাবাদে আসার পর থেকেই প্রতি বছর নিয়ম করে দিল্লির মসনদে বাৎসরিক কর সংগ্রহ করে পাঠাতেন। ওই বজরার যাত্রা শুরুর মুহূর্তে তোপ দাগা হত। ওই যাত্রাপথ মঙ্গলময় করতেই বেরা উৎসবের সূচনা। উর্দুবাজার ঘাটে দাঁড়ানো বড় নৌকায় (পাটেয়ালা) মালপত্র-সামগ্রী রাখা থাকত আর নবাবের উচ্চপদস্থ কর্মচারী রাজস্ব নিয়ে বজরায় থাকতেন। মুর্শিদকুলি খাঁ ‘মহলসরায়’ ভবন থেকে শোভাযাত্রা করে উর্দুবাজার ঘাটে পৌঁছাতেন। ১৫টি মোহর ও সোনার চিরাগ ১৫টি সোনার থালায় সাজিয়ে বজরার প্রধানের হাতে তুলে দিয়ে যাত্রার সূচনা করতেন।

আশা-আকাঙ্ক্ষা
লালবাগ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “বেরা উৎসব নিয়ে সরকারি স্তরে প্রচার হোক।” মুর্শিদাবাদ পুরসভার কাউন্সিলর তথা জেলা কংগ্রেস কমিটির সদস্য বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, “রাস বা জগদ্ধাত্রী উৎসবকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটলেও আলোর উৎসব হওয়া সত্ত্বেও বেরা উৎসব অন্ধকারেই রয়ে গিয়েছে। বেরা উৎসবকে ঘিরে যে প্রচার চালানোর দরকার, সরকারি স্তরে তা হয় না। ফলে পর্যটন মরশুমে দেশি-বিদেশি কয়েক লক্ষ মানুষের ভিড় হলেও প্রচার ও প্রসারের অভাবে ওই উৎসব জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। এই আক্ষেপ নতুন সরকারের আমলেও ঘুচল না!” জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি মহম্মদ আলি বলেন, “বেড়া উৎসব যাতে সর্বজনীন হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে সরকারের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা রয়েছে। আশা করছি আগামী দিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ওই উৎসবে ভিড় করবেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.