বাঘমুণ্ডির মৃত্যু-আতঙ্ক কাটিয়ে আবার পাহাড় জয়ের নেশায় মেতেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে হিমাচলের একটি শৃঙ্গে পা-ও রেখেছেন সেখানকার চার পড়ুয়া। তবে তার আগে আতঙ্ক কাটানোর লড়াই চালাতে হয়েছে দীর্ঘ ছ’বছর।
সালটা ২০০৬। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রছাত্রী পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের বাঘমুন্ডি গিয়েছিলেন ‘রক ক্লাইম্বিং’ করতে। শৈলারোহণের শিক্ষণ পর্বেই নেমেছিল তুমুল বৃষ্টি। তার জেরে রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠে পাহাড় সংলগ্ন ছোট্ট নদী। হড়পা বানে ভেসে যান চার জন। কোনও মতে বেঁচে ফিরে আসেন এক ছাত্র। সেই মর্মন্তুদ ঘটনার পরে যাদবপুরের মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব প্রায় উঠে যেতে বসেছিল। এটিই রাজ্যের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানকার মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব ফি-বছরই অভিযান ছাড়াও শৈলারোহণ সংক্রান্ত নানা কাজকর্ম চালাত। বাঙালির ‘ঘরকুনো’ তকমা মুছতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ওই সংগঠনের। কিন্তু বাঘমুণ্ডির সেই দুর্ঘটনার ধাক্কায় ক্লাবের সব কার্যকলাপই বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা চলে বছর তিনেক। |
২০০৯ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে আবার শুরু হয় পাহাড়ে যাওয়া। অবশ্য প্রথমেই শৃঙ্গাভিযান নয়, ১২-১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় ট্রেকিং বা পাহাড়ি পদযাত্রা। যেমন গোচালা বা সান্দাকফু। একটু একটু করে সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে গত জুনে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পাড়ি দেন হিমাচলের ২০ হাজার ৭০ ফুট উঁচু ইউনাম শৃঙ্গের পথে। দলে ছিলেন সাত জন। চূড়ায় পা রাখেন চার জন। এই অভিযান সফল হওয়ায় বহু দিন পরে যেন নতুন করে প্রাণ পেয়েছে ক্লাবটি। শুরু হয়েছে নতুন স্বপ্ন দেখা। এমনকী সেই স্বপ্নের মধ্যে আছে মাউন্ট এভারেস্টও।
যাঁরা ইউনাম শিখর ছুঁয়ে আসতে পেরেছেন, তাঁরা হলেন তিয়াস মুখোপাধ্যায়, প্রসূন সিংহ, নবিরুল ইসলাম ও কিংশুক চট্টোপাধ্যায়। তিয়াস যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। কিংশুক এ বছরই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন যাদবপুর থেকে। প্রসূন ও নবিরুল ওখানেই ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এ ছাড়াও ওই দলে ছিলেন অর্পিতা মৈত্র ও সৌমিত্রকুমার দিন্দা। দু’জনেই যাদবপুরের প্রাক্তনী। গাইড হিসেবে ছিলেন ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সম্পাদিকা তিয়াস জানান, তাঁরা কলকাতা থেকে মানালি হয়ে পৌঁছন ভরতপুরের মূল শিবিরে। ভরতপুর বেস ক্যাম্পের উচ্চতা ১৫ হাজার ফুট। সেখানে গিয়ে অর্পিতা ও সৌমিত্র অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁরা মূল শিবির থেকে আর এগোতে পারেননি। ১৮ জুন ভোর ৪টেয় অর্পিতা, সৌমিত্র এবং ইন্দ্রনাথবাবু ছাড়া চার জনের দলটি উপরে উঠতে শুরু করে। আট ঘণ্টারও বেশি সময় লড়াই করে বেলা ১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তাঁরা ইউনামের শীর্ষে পৌঁছন। সন্ধ্যার আগেই আবার নেমে আসেন মূল শিবিরে।
তিয়াসের সহযাত্রী প্রসূন বলেন, “শীর্ষে পৌঁছনোর আগে থেকেই উচ্চতার কারণে বাতাসে অক্সিজেন বেশ কম ছিল। ফলে পাহাড় ভাঙতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পাহাড়ে ওঠাটাই কষ্টকর, নামার সময় ততটা কষ্ট হয়নি। সময়ও কম লেগেছিল।”
যাদবপুরের ডিরেক্টর অফ ইউথ ওয়েলফেয়ার বাপ্পা মল্লিক বলেন, “২০০৬-এর বাঘমুণ্ডির পরে এই মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে কেউ আসতই না। ২০০৯ সালের পরে ধারণাটা আমরা বদলাতে পেরেছি। পাহাড়ে চড়াটা তো একটা নেশা। আমরা চাই, ছেলেমেয়েরা আসুক।” কিন্তু কিছু অসুবিধার কথাও জানান বাপ্পাবাবু। তিনি বলেন, “পাহাড় চড়ায় মোটামুটি দক্ষ হতে অন্তত আট বছর লাগে। কিন্তু এখানে ছেলেমেয়েরা ৪-৫ বছরের রেশি থাকতে পারে না। তৈরি হতে না-হতেই ছেড়ে চলে যায়।” তিনি জানান, নতুন প্রজন্মকে পাহাড়মুখী করতে একাদশ যোজনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর অনুদান থেকে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করে সল্টলেক ক্যাম্পাসে ৫০ মিটার উঁচু একটি কৃত্রিম ‘রক ক্লাইম্বিং ওয়াল’ তৈরির কাজ চলছে।”
যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “এই মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমবয়সি। তাই এই ক্লাবের ছেলেমেয়েরা আমাদের কাছে খুব প্রিয়। চেষ্টা করতে করতে যদি ওরা সত্যিই এক দিন এভারেস্ট জয় করে আসতে পারে, আমাদের খুব ভাল লাগবে।” |