পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
সেই সিঙ্গুর। সেই জমি-জট। কিন্তু দিনের শেষে আশার আলো, ন্যানো প্রকল্পের মতো আটকে গেল না সাবস্টেশনে বিদ্যুতের লাইন আনার কাজ। যদিও বিকল্প পথে খরচ বাড়বে অনেকটাই। কিন্তু এর ফলে রাজ্যে বিদ্যুৎ সংবহনে নতুন প্রযুক্তি তো আমদানি হবেই, তা ছাড়া ২০০৬ সাল থেকে আটকে থাকা প্রকল্পটির জটও খুলে যাবে বলে আশা সকলের।
সিঙ্গুরে টাটা মোটরস কারখানার জন্য তৈরি হয়েছিল একটি সাবস্টেশন। ঠিক হয়েছিল, ওই সাবস্টেশন থেকে ন্যানো গাড়ির কারখানা ছাড়াও হুগলি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে রাজ্য বিদ্যুৎ সংবহন সংস্থা। কিন্তু জমি না মেলায় সাবস্টেশন পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসা যায়নি বিদ্যুতের লাইন। সিঙ্গুরের আশেপাশে যে সমস্ত মৌজা দিয়ে টাওয়ার বসিয়ে হাই-ভোল্টেজ লাইন নিয়ে আসার নকশা করা হয়েছিল, তার জন্য এক ছটাক জমিও ছাড়তে চাননি স্থানীয় বাসিন্দারা।
সেই সমস্যা মোকাবিলায় অবশেষে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ঠিক হয়েছে, সেচ দফতরের জমি ব্যবহার করেই বিশেষ ধরনের খুঁটি লাগিয়ে (মনোপোল টাওয়ার) বিদ্যুৎ নিয়ে আসা হবে সিঙ্গুরের সাবস্টেশনটিতে। এর ফলে বিদ্যুৎ সংবহন সংস্থার অতিরিক্ত ৩৬ থেকে ৩৮ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। |
এই ধরনের মনোপোল টাওয়ার দিয়েই বিদ্যুতের লাইন টানা হবে।—নিজস্ব চিত্র |
জমি পেলে সাধারণ টাওয়ার বসিয়ে বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে যেখানে খরচ পড়ত ১২ থেকে ১৪ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর, এখন ওই একই কাজের জন্য খরচ হবে অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ আইনে জমি অধিগ্রহণ বা কেনার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, মানুষকে বুঝিয়ে জমি নিতে হবে। তার জন্য যদি শস্যের ক্ষতি হয় বা ঘরবাড়ি ভাঙা পড়ে, তা হলে সেই জমি বা বাড়ির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু টাওয়ার বসানোর জন্য ছোট হলেও যে মাপের জমি নেওয়া হয়, তার জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভারতীয় বিদ্যুৎ আইনে বলা নেই। অর্থাৎ, বিদ্যুতের খুঁটি পোঁতার জন্য যে জমি দরকার, তা পুরোপুরি মানুষের সদিচ্ছা বা সদর্থক মনোভাবের উপরে ভিত্তি করে সংগ্রহ করা হয়। শুধু সিঙ্গুরের প্রকল্পটি নয়, সারা রাজ্যে এই মুহূর্তে চালু বা প্রস্তাবিত ৩৮টি প্রকল্পের মধ্যে ১২-১৪টি এই জমি জটে আটকে আছে। এবং তা-ও দীর্ঘদিন ধরে। বাম সরকারের আমলেও বুঝিয়ে সুজিয়ে এগুলির জট খোলা যায়নি। পরে সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ায় তার হাওয়া লেগেছে এই প্রকল্পগুলির গায়েও। ফলে জট খোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার জন্য প্রায় ১৬ একর জমির উপরে ২২০ কেভির ওই সাবস্টেশনটি তৈরি করা হয়। কিন্তু ন্যানো কারখানার মতোই সাবস্টেশনটির জন্য লাইন আনতে বিদ্যুতের খুঁটি (টাওয়ার) বসাতে যে জমি দরকার, তা জোগাড়ে নেমে প্রবল বাধার মুখে পড়ে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসেও সুরাহা হয়নি। এর পরে জাতীয় সড়কের জমির উপর দিয়ে বিদ্যুতের তার আনার প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দেননি। সম্প্রতি সেচ দফতর জমি দিতে রাজি হওয়ায় বিকল্প পথে বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে চলেছে রাজ্য বিদ্যুৎ দফতর।
ঠিক হয়েছে, সরস্বতী নদী, কাট ক্যানাল সংযোগস্থল এবং দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে (২ নং জাতীয় সড়ক) বরাবর ২২০ কেভি ডবল সার্কিট লাইন টানা হবে। সেই জমিতে সাবেক টাওয়ার বসানো হবে না। কম জমিতেই যাতে কাজ হয়ে যায়, তার জন্য মনোপোল টাওয়ার বসিয়ে বিদ্যুৎ লাইন টানার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যা এই রাজ্যে প্রথম। বিদেশ থেকে এই স্তম্ভগুলি আমদানি করা হবে। প্রায় ১২ কিলোমিটার পথে ৪৬টি স্তম্ভ বসানোর নকশা তৈরি হয়ে গিয়েছে। টাওয়ারগুলিতে থাকবে চারটি করে ‘হাত’। ওই হাতের উপর দিয়েই হাইটেনশন বিদ্যুতের লাইন টানা হবে। বিদ্যুৎ কর্তারা জানাচ্ছেন, একটি মনোপোল বসাতে আড়াই বর্গমিটার জায়গা হলেই চলবে। তাই খরচ কিছু বেশি হলেও জমি কম লাগবে, আর তাই জটিলতা কম হবে বলেই বিদ্যুৎ কর্তাদের দাবি। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে এ ভাবেই হবে বিদ্যুৎ সংবহনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
রাজ্য বিদ্যুৎ সংবহন সংস্থার চেয়ারম্যান অমরেশচন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, সিঙ্গুরের সাবস্টেশনটি চালু হয়ে গেলে হুগলি জেলায় বিদ্যুৎ পরিষেবার মান আরও উন্নত হবে। আবার ওই সাবস্টেশনটির মাধ্যমে আশেপাশের বহুমানুষ তো বটেই, নতুন কারখানা বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারবে। |
সহপ্রতিবেদন: গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় |