রানওয়ে-নিরাপত্তা শিকেয়
সোনাগাছির অন্ধকার থেকে সুখের সংসারে, সিনেমায় ঠিক যেমন হয়
জীবনের সঙ্গে সিনেমার চিত্রনাট্যের মিল ঘটে যায় কখনও কখনও। কিন্তু এ যেন সিনেমার সঙ্গে মিলে গেল জীবন।
২ অগস্ট কলকাতায় বিক্রম অগ্রবাল (নাম পরিবর্তিত) আর মানালি সিংহের (নাম পরিবর্তিত) বিয়ের আসরে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অনেকেরই মনে হচ্ছিল এই কথাটা।
নিজের বাবা-মা জোর করে যৌনপেশায় ঢুকিয়েছিলেন নাবালিকা মেয়েকে। কিন্তু সেই পেশার সূত্রেই ঘটে গেল প্রেম, দুঃস্বপ্ন বদলে গেল মাধুর্যে। প্রেমিকের হাত ধরে যৌনপল্লি থেকে পালিয়ে গেলেন মানালি। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল ক’দিন বাদে। শ্বশুর-শাশুড়িও বৌমাকে সাদরে কাছে টেনে নিলেন। মানালির দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হল তাঁর নিজের বাবা-মাকে।
যৌনকর্মীর সঙ্গে গ্রাহকের প্রেম ও পরিণয় হিট সিনেমার জনপ্রিয় ফর্মুলা। কিন্তু সঞ্জয় দত্ত-পূজা ভট্টের ‘সড়ক’, বিনোদ খন্না-মাধুরী দীক্ষিতের ‘দয়াবান’ কিংবা সলমন-নগমার ‘বাগি’ সব ছবিই যেন ফিকে হয়ে গিয়েছে বিক্রম-মানালির গল্পের কাছে।
কী ভাবে যৌনপল্লিতে এসে পড়েছিলেন মানালি? লালবাজারের নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ দফতরের অফিসাররা জানালেন, মানালির মা ছিলেন আগরা ঘরানার বাঈজি। আগরাতেই থাকতেন। মানালি অবশ্য মানুষ হয়েছেন মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদে, দাদু-দিদার কাছে। সেখানেই মাধ্যমিক পাশ করেন। সতেরো বছর বয়স হতে বাবা-মা তাঁকে প্রথমে আগরায়, তারপর সেখান থেকে জোর করে সোনাগাছিতে নিয়ে আসেন। মানালি বলেন, “কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলাম, ‘আমাকে ছেড়ে দাও।’ লাভ হয়নি।”
সোনাগাছির জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল নাবালিকা মানালির কাছে। জোর-জবরদস্তির সীমা ছিল না। “খরিদ্দারের কাছে যেতে না-চাইলে বাবা গুন্ডাদের দিয়ে মারধর করাত। ওরা সব সময় পাহারা দিত আমাকে। রোজগারের সব টাকা নিয়ে নিত।” এই ভাবে পাঁচ মাস কাটার পর বিক্রমের প্রবেশ।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
বিক্রমের বয়স তিরিশ ছুঁই-ছুঁই। মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। নিজে শেয়ার বাজারের কাজকর্ম করেন। খরিদ্দার হিসেবেই গিয়ে পড়েছিলেন মানালির কাছে। মানালি মনে করতে পারেন, “আমি কাঁদছি দেখে বিক্রম আমাকে স্পর্শ করেনি। সারা রাত ধরে আমার কথা শুনেছিল শুধু।” ‘দয়াবান’ ছবিটার কথা মনে পড়তে পারে। ‘দয়াবান’-এর নায়ক বিনোদ খন্নাও যৌনকর্মী মাধুরীর পরদিন পরীক্ষা রয়েছে শুনে সারা রাত পড়তে দিয়েছিলেন। স্পর্শ পর্যন্ত করেননি। সে রাতেই মানালির মনে হয়েছিল, মানুষটি আলাদা ধরনের। আর পাঁচ জনের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল।
বিক্রম প্রায়ই আসতেন এর পর। ভালবাসার সেই শুরু। প্রথম যে দিন মানালির কাছে গিয়েছিলেন, সে দিন গিয়েছিলেন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। মানালিকে জানিয়েওছিলেন সেটা। “বিক্রম আমাকে বলেছিল, ও বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিল।” কিন্তু তার পর মানালির সঙ্গে দেখা করতেই ও পাড়ায় যেতেন তিনি। ‘সদমা’ ছবিতে শ্রীদেবীর অবস্থা দেখে থাকতে না-পেরে তাঁকে নিয়ে যৌনপল্লি থেকে পালিয়েছিলেন কমল হাসন। মানালিরাও পালালেন এক দিন।
কী ভাবে? মানালি বলেন, “বিক্রমই আমাকে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নম্বর জোগাড় করে এনে দেয়। তার পর পাড়ার গুন্ডাদের টাকা দিয়ে মদ খেতে পাঠিয়ে দেয়। সেই ফাঁকে ভোরবেলা ২২ নম্বর দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পালাই।” তারিখটা ছিল, এ বছরের ২১ মার্চ। সোনাগাছি থেকে সোজা রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এ ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অফিসে চলে গিয়েছিলেন মানালি। সেখান থেকে লালবাজার। সেখানে মানালি নিজেই বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। ওঁদের গ্রেফতার করা হয়। এখনও তাঁরা জেল হেফাজতেই রয়েছেন। লালবাজার থেকেই মানালিকে বেহালার একটি হোমে পাঠিয়ে দেয় রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি’-র (সিডব্লিউসি) কলকাতা শাখা।
চমকের শুরু তার পরে। মানালির আঠারো বছর বয়স হতে তখন চার মাস বাকি ছিল। বিক্রম এক দিন বাবা-মা-ভাই সবাইকে নিয়ে চলে এলেন সিডব্লিউসি-র অফিসে। পরিবারের সকলেই অফিসারদের জানালেন, ছেলের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে মানালিকেই তাঁরা বাড়ির বউ করতে চান। ২৭ জুলাই মানালির আঠারো বছর হল। ওই দিনই বিশেষ বন্ড দিয়ে তাঁকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেলেন বিক্রম আর তাঁর মা-বাবা। ঠিক পাঁচ দিন পর, ২ অগস্ট ধুমধাম করে আত্মীয়স্বজন ডেকে মানালির সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিল অগ্রবাল পরিবার। নাগেরবাজারের শ্বশুরবাড়িতে এখন জমিয়ে সংসার করছেন মানালি। তাঁকে জড়িয়ে ধরে শাশুড়ি বলেন, “এমন বৌমা ক’জন পায়? হাতে ধরে রান্নাবান্না শেখাচ্ছি।” কিন্তু সমাজ যদি আঙুল তোলে? ষাট পার করা অগ্রবাল-গৃহিণীর দৃপ্ত জবাব, “বাচ্চা মেয়েটা নতুন করে বাঁচছে, তাকে অসম্মান করার ক্ষমতা কারও নেই।”

ফরেস্ট রেঞ্জার সেলিম আহমেদ খান ট্রেনে
যাচ্ছেন। চোখ আটকে গেল ফর্সা, আলতা-মাখা
দু’টো পায়ে। ছবির নাম ‘পাকিজা।’

কোটিপতি ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড লিউইস আর
যৌনকর্মী ভিভিয়ানের গল্প। জুলিয়া রবার্টসকে
প্রেম নিবেদন রিচার্ড গ্যেরে-র। ‘প্রিটি উওম্যান।’

পুষ্প-র সঙ্গে বর্ধিষ্ণু বাড়ির অনঙ্গবাবুর
সম্পর্কের বুনোটে তৈরি উত্তম-সাবিত্রীর
‘নিশিপদ্ম’, হিন্দিতে রাজেশ-শর্মিলার ‘অমর প্রেম।’

জনপ্রিয় দক্ষিণী ছবির হিন্দি রিমেক। উদার
মনের মাফিয়া ডনের সঙ্গে যৌনকর্মী নীলুর প্রেম।
পরিণয়ও। আশির দশকের হিট ছবি ‘দয়াবান’।
সোনাগাছি এলাকাতেই প্রায় ১৭ বছর কাজ করছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের কর্মী মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় জানালেন, এই রকম আরও দু’টি ঘটনার কথা মনে পড়ে তাঁর। এক জনের বিয়ে হয়েছিল সরকারি বিমা সংস্থার কর্মীর সঙ্গে। আর এক জনের বিয়ে হয় এক উকিলের সঙ্গে। এই মহিলার আগের পক্ষের দুই মেয়েও ছিল। মেয়ে দু’টিকেও তাঁর নতুন স্বামী মেনে নিয়েছিলেন, কাছে রাখতে দিয়েছিলেন।
মানালি-বিক্রমের জীবনও সুখ-শান্তিতে ভরে উঠুক, এমনটাই এখন চাইছেন সকলে। দেওয়ালির পরে বিক্রমের সঙ্গে মুম্বই চলে যাওয়ার কথা মানালির। ওঁর এখন একটাই চিন্তা, “আমার বাবা-মা টাকা পয়সা দিয়ে কোনও ভাবে ছাড়া পেয়ে যেন বিক্রমের ক্ষতি না-করতে পারে!”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.