নাচ-গান-নাটকে মনোরোগের দাওয়াই
নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন হতাশায় ভোগা বছর বাইশের তরুণী। কিন্তু সিলিং ফ্যান থেকে যখন নামানো হয় ভাগ্যক্রমে তখনও শরীর নিথর হয়নি। চিকিৎসায় শরীর সুস্থ হলেও বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেন তিনি। তার পর এক দিন নতুন এক বন্ধু হাত বাড়ায় ওঁর দিকে। বন্ধুর নাম ‘মিউজিক’। যা মেয়েটির মধ্যে ফের জাগিয়ে তোলে বাঁচার ইচ্ছে। এই ‘ভাল থাকা’ যাঁর হাত ধরে সম্ভব হয়েছিল, তিনি এক জন ‘পারফর্মিং আর্টস থেরাপিস্ট’।
পাঁচ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পরে একা হাতে তাঁকে দাহ করেছিলেন নিঃসন্তান, ৬৫ বছরের বিভাদেবী (নাম পরিবর্তিত)। কাঁদার সময়টুকুও পাননি সে দিন। তার পর থেকে ঠিকানা চেতলার এক বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু সেখানে আবাসিকদের সঙ্গে কিছুতেই মিশতে চাইতেন না তিনি। এক দিন বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছয় পারফর্মিং আর্টস থেরাপির এক দল ছাত্রছাত্রী। শুরু হয় নাচ-গান-নাটকের রিহার্সাল। তখনও নিজেকে লুকিয়েই রাখতেন বিভাদেবী। শেষমেষ অনেক বুঝিয়ে তাঁকে ‘পারফর্ম’ করতে রাজি করানো হয়। মঞ্চে ওঠার পরে খানিকক্ষণ হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পরে বলতে শুরু করেন মৃত স্বামীকে দাহ করতে গিয়ে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার কঠিন অভিজ্ঞতার কথা। খানিকটা নাটকের আদলে তিনি যে নিজের গল্পই বলছিলেন, সেটা কাউকে বলে দিতে হয়নি। বহুদিনের চেপে রাখা কষ্ট এ ভাবে প্রকাশ পাওয়ার পরে বিভাদেবীর দু’চোখে তখন জলের ধারা। অশক্ত শরীর নিয়েও তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দিতে উঠে এসেছিলেন অন্যেরা। এর পর থেকে সকলের সঙ্গে মিশতে শুরু করেন বিভাদেবী। তাঁর কথায়, “এই ছেলেমেয়েগুলো শিখিয়ে দিল মনের কষ্টকে সুর-তাল-ছন্দে ভাগ করে নিলে বাঁচাটা অনেক সহজ হয়ে যায়।”
দেশের বিভিন্ন শহরে ইতিমধ্যেই এই থেরাপি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ত্রিপুরা কাশ্যপ, প্রীতি পটেলদের হাত ধরে ছড়িয়েছে নানা শহরে। বরং কলকাতাতেই বিষয়টি এখনও নতুন। বহু সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্য ব্যক্তিত্ব অনেক দিন ধরেই নিজস্ব উদ্যোগে ব্যক্তি বা সমাজের ‘ভাল করা’র নানা ব্যক্তিগত প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু এ শহরে বিচ্ছিন্ন এই প্রয়াসগুলোকে একটা প্রতিষ্ঠানের ছাতার নীচে আনার কথা প্রথম ভেবেছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৯ সালে ইউজিসি-র অনুমোদনে শুরু হয় ‘পারফর্মিং আর্টস থেরাপি’র পাঠ্যক্রম।
চলছে পারফর্মিং আর্টস থেরাপি। শহরের এক বৃদ্ধাশ্রমে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
রবীন্দ্রভারতীর পারফর্মিং আর্টস থেরাপি সেন্টারের ডিরেক্টর অমিতা দত্তের কথায়, “যে মানুষ শারীরিক ভাবে অসুস্থ, কেবল তিনিই রোগী নন। যার মনের অসুখ করে, তিনিও রোগী। কেউ যখন অপরাধ করে, তখন মন সুস্থ নয় বলেই সে তা করে। এই অসুস্থ মনকেই ভাল করে তুলতে পারেন এক জন পারফর্মিং আর্টস থেরাপিস্ট।”
নাচ-গান-আবৃত্তি বা নাটকের ঠিকমতো প্রয়োগে এক জন রোগীর ওটি-ট্রমা বা অপারেশন পরবর্তী ‘ভয়’ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মত চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুরের। তিনি বলেন, “লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া করে অস্ত্রোপচারের সময়ে ওটিতে রোগীর প্রচণ্ড ভয় ও টেনশন হয়। তখন তাঁদের কানে পছন্দসই মিউজিক চালালে দেখা যায় একটা রিল্যাক্স ভাব আসে। অনেকেই ‘ওটি-ট্রমা’ ভুলে যান।”
তবে এ ধরনের থেরাপির ক্ষেত্রে সঠিক মিউজিক নির্বাচনই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের সাইকোলজি রিসার্চ ইউনিটের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর দেবদুলাল দত্তরায়। তিনি বলেন, “থেরাপিস্টকে রোগীর সঙ্গে বারবার কথা বলে তাঁর পছন্দটা জেনে নিতে হবে। কারণ যে রোগীর হার্ড রক মিউজিক পছন্দ, তাঁর ক্ষেত্রে রাগসঙ্গীত প্রয়োগ করে লাভ হবে না। আবার যদি রোগী রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালবাসেন, তা হলে তাঁর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রকবিতা বা নাটকের সাহায্যেও পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে এক জন পারফর্মিং আর্টস থেরাপিস্টের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, রোগীর মনের অবস্থাটা নির্ণয় করা, যা যন্ত্রের সাহায্যে সম্ভব নয়। এ জন্য থেরাপিস্টের মনোবিদ্যা বিষয়েও যথেষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন।”
শুধু পারফর্মিং আর্টসকে ব্যবহার করে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অপরাধপ্রবণ মানুষকে যে ফের সুশীল সমাজে ফেরানো যায়, তা ইতিমধ্যেই হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়। তাঁর উদ্যোগে সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নৃত্যনাট্য বদলে দিয়েছে বহু অপরাধীর মন। শহরে যে সব পারফর্মিং আর্টস থেরাপিস্টরা কাজ করছেন, এই ঘটনা তাঁদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে বলে মনে করেন অমিতাদেবী। তাঁর কথায়, “শুধু অসুস্থ মনই নয়, অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রেও এই থেরাপি প্রয়োগ করে যথেষ্ট সুফল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হল, আমাদের শহরে এই থেরাপির কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনও যথেষ্ট সচেতনতা নেই। নাচ-গান-নাটক কারও কাছে আমোদের বিষয়, কারও কাছে শিল্প। এর বাইরেও যে এর একটা কার্যকারিতা আছে, সেটা বোঝানোটাই থেরাপিস্টদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।” রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফর্মিং আর্টস থেরাপি বিভাগের এক ছাত্রী বললেন, “বহু জায়গায় কাজ করতে গিয়ে আমাদের শুনতে হয়, গানের দিদি অথবা নাচের দিদি এসেছেন। এক জন পারফর্মিং আর্টস থেরাপিস্ট যে নাচ বা গানের দিদির থেকে আলাদা, সেই সচেতনতায় আমাদের শহর এখনও পিছিয়ে। এ ছাড়াও, বিদেশের হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ডাক্তারদের পাশাপাশি এ ধরনের থেরাপিস্টরা অপরিহার্য হলেও আমাদের শহরে সে ধরনের কাজের সুযোগও সচেতনতার অভাবেই যথেষ্ট কম।’’ ক্ষতি কী? যদি ‘গারদে’র বদলে ‘সুর’ বদলে দেয় অপরাধী মনকে? নিঃসঙ্গতা, অবসাদ কাটিয়ে উঠতে কড়া অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে সঙ্গী হয়ে ওঠে কবিতা? আর জীবনের শেষ হয়ে আসা দিনগুলো গুনতে গিয়ে গুনতি ভুল হেসে ওঠেন আরও কিছু মানুষ? আখেরে তাতে লাভ তো আমাদেরই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.