টানা জেরায় খুন কবুল, নিহতের কর্মী-সহ ধৃত ৪
জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে এক জনের বয়ানে অসঙ্গতি এবং ঘটনার দিন তার মোবাইলের টাওয়ার-অবস্থান দেখে গোয়েন্দাদের খটকা লেগেছিল। আর সেই সন্দেহের সূত্র ধরেই বেহালা-হত্যাকাণ্ডের ‘কিনারা’ হয়েছে বলে পুলিশের দাবি।
বৃহস্পতিবার রাতে বেহালার প্যারিসপাড়ার দোতলা বাড়িতে মিলেছিল দীপক ভট্টাচার্য, তাঁর বৃদ্ধা মা গৌরী ভট্টাচার্য, পরিচারিকা অণিমা মণ্ডল ও গৌরীদেবীর আয়া ময়না রায়ের গলাকাটা দেহ। তদন্তে নেমে কেবল-ব্যবসায়ী দীপকবাবুর এক কর্মীকে শনিবার রাতে আটক করেছিল পুলিশ। মুন্না ঢালি নামে ওই যুবককে জেরা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আটক হয় আরও তিন জন নব ঢালি, বিজয় ওরফে রাজেশ দাস ও সাত্তার মণ্ডল।
তদন্তকারীদের দাবি, বৃহস্পতিবার দুপুরে এই চার জনই ভট্টাচার্য-বাড়িতে ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালায়। মুন্না খুনের কথা কবুলও করেছে বলে পুলিশের দাবি। রবিবার লালবাজারে সাংবাদিক বৈঠকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার
বৃহস্পতিবারের বারবেলা
রঞ্জিতকুমার পচনন্দা জানান, চার জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে খুনের অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি।
ধৃতদের পরিচয় কী? পুলিশ-সূত্রের খবর, হরিদেবপুর ঢালিপাড়ার বাসিন্দা মুন্না গত সাত মাস ধরে দীপকবাবুর অধীনে কেবল লাইন সারাইয়ের কাজ করত। ইদানীং গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক টাকা আদায়ও করত সে। আগে সে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলায় কাজ করত, সেই সূত্রে ওখানকার কেবল-কর্মী বিজয়ের সঙ্গে তার আলাপ। সাত্তার ও নব রাজমিস্ত্রি, বাড়ি ঢালিপাড়ায়।
রহস্যভেদ হল কী ভাবে?
পুলিশ জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে খুনের ‘সময়’টা অন্যতম ভূমিকা নিয়েছে। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, নিহতদের পাকস্থলীতে খাবার ছিল না। যা থেকে গোয়েন্দারা অনুমান করেন, দুপুরের খাওয়ার আগেই তাঁদের মারা হয়েছে। ধারণাটি জোরালো হয় শুক্রবার, যখন ফের ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্তকারীরা দেখেন, ঠাকুরঘরে পুজোর ফুল ও কাটা ফল পড়ে। হেঁসেলে রান্না করা খাবার। পাশাপাশি গৌরীদেবীর আর এক আয়া সন্ধ্যা গোস্বামী পুলিশকে জানান, ওই বাড়িতে রোজ দুপুরের খাওয়া হতো বেলা বারোটা নাগাদ, পুজো শেষ হওয়ার পরে।
তখনই পুলিশ বুঝতে পারে, খুন হয়েছে বেলা বারোটার আগে। ময়না-তদন্ত রিপোর্টেও যার সমর্থন মেলে। ভট্টাচার্য-বাড়িতে কোন সময়ে কারা আসা-যাওয়া করত তা যাচাই করতে গিয়েই মুন্নার উপরে নজর পড়ে। জানা যায়, মুন্না সকালের দিকে দীপকবাবুর বাড়ি আসত। গ্রাহকদের থেকে আদায় করা টাকা বুঝিয়ে দিয়ে যেত। সেই সঙ্গে বুঝে নিত সারা দিনের কাজ। সেখান থেকে বেলা এগারোটা নাগাদ সে অফিসে যেত।
রহস্য-ভেদের সূত্র
• ঠাকুরঘরে পড়ে পুজোর ফুল এবং কাটা ফল
• রান্নাঘরে পড়ে দুপুরের খাবার
• পুজো করে তবে খেতেন গৌরীদেবী, দীপকবাবু
• দেরিতে অফিসে পৌঁছনো নিয়ে মুন্নার মিথ্যা বয়ান
• মুন্নার মোবাইল‘টাওয়ার লোকেশন’
কিন্তু ঘটনার দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সে অফিসে পৌঁছেছিল দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ।
এতেই মুন্না গোয়েন্দাদের সন্দেহ-জালে পড়ে যায়। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সে নানা এলোমেলো কথা বলে। এমনও বলে, ওই দিন সে নাকি প্যারিসপাড়ায় আসেইনি! অথচ মুন্নার মোবাইল ফোনের ‘টাওয়ার লোকেশন’ দেখে পুলিশ জানতে পারে, বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটা থেকে প্রায় সওয়া বারোটা পর্যন্ত সেটা প্যারিসপাড়াতেই ছিল।
এটা জানার পরেই মুন্নাকে ফের ঠাকুরপুকুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। লাগাতার জেরার মুখে সে ভেঙে পড়ে। রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে। তদন্তকারীদের দাবি, মুন্না অপরাধ স্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে তিন শাগরেদের নামও বলে দেয়। রাতেই বাকি তিন জনকে বাড়ি থেকে লালবাজারে তুলে আনা হয়।
ঠিক কী হয়েছিল বৃহস্পতিবার?
পুলিশ জানিয়েছে, ওই দিন সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ ভট্টাচার্য-বাড়িতে গিয়েছিল মুন্না। গৌরীদেবী-দীপকবাবুর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে মোবাইলে মিস্ড কল দেয় ‘তৈরি থাকা’ শাগরেদদের। মুন্নার সেই ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেয়েই নব-বিজয়-সাত্তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। রান্নাঘরে একটা রুটি বেলার কাঠের বেলুন দিয়ে তারা অণিমার মাথায় মারে, পরে তার গলার নলি কেটে দেয়। আওয়াজ পেয়ে ময়না নীচে নেমে এলে তাঁর সঙ্গে আততায়ীদের ধস্তাধস্তি হয়। তাঁর মাথাতেও কাঠের বেলুন দিয়ে আঘাত করা হয়। বেলুনটি ভেঙে যায়। শেষমেশ ময়নার মাথায় স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে মেরে তাঁর গলা কাটা হয়। ইতিমধ্যে মুন্না সিঁড়ির কাছে এসে শাগরেদদের উপরে ডাকে। ত্রিমূর্তি দোতলায় উঠে প্রথমে দীপকবাবুর উপরে চড়াও হয়। দেওয়ালে তাঁর মাথা ঠুকে দিয়ে গলা কেটে ফেলে। সব শেষে কাটা হয় গৌরীদেবীর নলি।
চার জনের গলার নলি কি এক জনই কেটেছে?
তদন্তকারীদের সামনে এটাও ছিল মস্ত প্রশ্ন। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, সকলের গলা কাটা হয়েছে ডান হাতে। আঘাতও মোটামুটি এক ধরনের। যার ভিত্তিতে গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুমান ছিল, গলা কেটেছে এক ব্যক্তিই। কিন্তু জেরায় জানা যাচ্ছে, গলা কেটেছে দু’জন। মুন্নার দাবি মোতাবেক, গলা কেটেছে বিজয় ও নব। বিজয় কেটেছে অণিমা ও দীপকবাবুর গলা। ময়না ও গৌরীদেবীর গলা কাটে নব।
পুলিশ আরও জানিয়েছে, চার জনকে নিকেশ করার পরে আততায়ীরা স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে দু’টো কাঠের আলমারি খোলে। তাতে টাকা-পয়সা কিছু মেলেনি। তখন স্টিলের আলমারি ভাঙার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে বাড়ির ল্যান্ডলাইনে একটা ফোন আসে। মুন্না অসতর্ক ভাবে রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলেই ফোন কেটে দেয়। তার পরেই ধরা পড়ার ভয়ে চার জন তড়িঘড়ি ভট্টাচার্য-বাড়ি ছেড়ে চম্পট দেয়।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.