আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন হয়, এ অনেকটা তেমনই। সবই উল্টো দিকে হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অন্ত্র থেকে শরীরের ভিতরের অধিকাংশ যন্ত্রই। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলে ‘সাইটাস ইনভার্সাস’। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় না থাকলেও ওই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে যে কোনও অস্ত্রোপচারই যথেষ্ট ঝুঁকির বলে দাবি চিকিৎসকদের। তবে সম্প্রতি রাজ্যের দু’টি বেসরকারি হাসপাতালে এমনই দুই শিশু-সহ তিন জনের হৃদ্যন্ত্রে ‘সফল’ অস্ত্রোপচার হয়েছে।
‘সাইটাস ইনভার্সাস’-এর এক রোগিণীর হৃদ্যন্ত্রে একসঙ্গে চারটি অস্ত্রোপচার করে তাঁকে সুস্থ করে তুলেছেন কলকাতার ইএম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। শিশু দু’টির অস্ত্রোপচার হয়েছে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সারানো হয়েছে তাদের হৃদ্যন্ত্রের জন্মগত ত্রুটি। |
আমতার বাসিন্দা বছর ছেচল্লিশের অনিতা বাগ প্রায় আড়াই দশক ধরে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতার শিকার। তাঁর হৃৎপিণ্ডের চারটি ভালভের মধ্যে তিনটি প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বেঁচেছিলেন পালমোনারি ভালভের ভরসায়। সেই সঙ্গে ‘এওর্টিক অ্যানারিজম’ অর্থাৎ এওর্টা নামে যে নালীর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে, সেই নালীর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির শিকার হন তিনি। যে কোন মুহূর্তে নালী ফেটে মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল।
বাইপাসের ওই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক কুণাল সরকারের নেতৃত্বে এক চিকিৎসক দল টানা পাঁচ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে বদল করেন ‘মাইট্রাল’ এবং ‘এওর্টিক ভালভ’। ‘ট্রাইকাসপিড ভালভ’কেও মেরামত করা হয়। সারানো হয় ‘এওর্টা’র ত্রুটি।
কুণালবাবু বলেন, “অনিতাদেবীর হৃদ্যন্ত্রের অবস্থা খুব জটিল ছিল। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘গ্রেড ফোর হার্ট ফেলিওর’ বলা হয়। হাসপাতালে যখন তিনি আসেন শ্বাসকষ্টে এক পা-ও চলতে পারছিলেন না। তাঁর এই শারীরিক অবস্থায় অস্ত্রোপচার আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।”
ঝুঁকি ছিল দুর্গাপুরের ওই হাসপাতালে দুই শিশুর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও। এক জনের বয়স দু’বছর। অন্য জনের আড়াই। যেখানে তাদের অস্ত্রোপচার হয়েছে, দুর্গাপুরের বিধাননগরের সেই সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান সত্যজিৎ বসুর দাবি, “এমনিতেই ‘সাইটাস ইনভার্সাস’ বিরল। তার উপরে এক দিনে এমন দুই শিশুর হার্টের সফল অস্ত্রোপচারের ঘটনা বিরলতম।”
কী এই ‘সাইটাস ইনভার্সাস’? সত্যজিৎবাবু জানান, প্রচলিত নিয়মে হৃদ্যন্ত্র, পাকস্থলী, প্লিহা ইত্যাদি থাকে শরীরের বাঁ দিকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এ সবের অবস্থান সম্পূর্ণ উল্টো দিকে থাকে। অনেকে প্রথম দিকে শরীরে নানা যন্ত্রের এমন অবস্থানের কথা জানতেই পারেন না। পরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এই বিশেষ অবস্থানের কথা ধরা পড়ে। যেমন, কেউ হয়তো তলপেটের বাঁ দিকে ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখলেন, সেখানে তাঁর অ্যাপেনডিক্স রয়েছে। সাধারণ নিয়মে যা থাকার কথা ছিল ডান দিকে। |
সমস্যা জটিল হয় যদি ‘সাইটাস ইনভার্সাস’ থাকা শিশুর হৃদযন্ত্রে জন্মগত ত্রুটি ধরা পড়ে। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয় না। শিশু হৃদরোগ চিকিৎসক অচ্যুত সরকার বলেন, “সাইটাস ইনভার্সাসের শিশুর অস্ত্রোপচারের জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। একই দিনে এমন দু’টি শিশুর অস্ত্রোপচার যথেষ্ট প্রশংসনীয়।”
দুর্গাপুরের ওই বেসরকারি হাসপাতাল সূত্রের খবর, যে দু’টি শিশুর হৃদযন্ত্রে সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাদের মধ্যে রোহন শেখের বাড়ি নদিয়ার পলাশির গোবিন্দপুরে। দীপ মণ্ডল এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় থেকে।
দুই পরিবারেরই আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। রোহনের বাবা শেখ সাত্তার এবং দীপের বাবা সুনীল মণ্ডল জানান, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই। অনিতাদেবীর ক্ষেত্রেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। |